শ্বাসরুদ্ধকর ১৪ ঘণ্টার অভিযানে উদ্ধার হলো অপহৃত শিশু সিমন
নিউজ ডেস্ক।। তোয়াছিন ইসলাম। ডাক নাম সিমন। চার বছর বয়সী সিমন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা সাইফুল ইসলাম তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন পূর্ব নাখালপাড়ার লিচু বাগান এলাকায় ভাড়া থাকেন। তিনি প্রথম আলো পত্রিকার মুদ্রণ শ্রমিক। সীমিত আয়ের সংসারে ভাড়া বাসায় থেকে স্ত্রী ও পুত্রের মুখে দুবেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয় সাইফুলকে।
২৮ আগস্ট স্ত্রী ও পুত্রকে বের হয়ে সারাদিন শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা ঘুরে রাত ৮টার দিকে বাসায় ফেরেন সাইফুল। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর রান্নায় ব্যস্ত হয়ে হয়ে পড়ে সাইফুলের স্ত্রী। ছোট্ট সিমন ব্যস্ত হয়ে পড়ে খেলাধুলায়। ক্লান্ত সাইফুল স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে দিনব্যাপী ঘোরাঘুরির আনন্দঘন স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে বিছানায় শুয়ে।
এমন আনন্দঘন দিন নিমিষেই যে তার জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় দিনে পরিণত হবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি সাইফুল। রাত ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে স্ত্রীর চিৎকারে রুমের বাইরে আসেন সাইফুল। তার স্ত্রী জানায় রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় সিমনের খেয়াল রাখতে পারেননি। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সিমনকে।
সাইফুল ও তার স্ত্রীর আর্তচিৎকারে জড়ো হলো বেশ কিছু লোক। তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো বাসার চারপাশ। বাসা পেরিয়ে আশেপাশের রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, পরিচিতদের বাড়িঘর। খবর শুনে ছুটে এলো সাইফুলের কয়েকজন সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব ও আত্নীয়-স্বজন। আলাদা আলাদাভাবে খোঁজা হলো পুরো এলাকা। নাখালপাড়া, সাত রাস্তা, মহাখালী, রেলওয়ে স্টেশন, হাতিরঝিল, মধুবাগ, বিজয় স্বরণী, তেজগাঁও এলাকা।
আত্নীয়-স্বজনেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে চলে গেল ডিএমপির সব থানায়। ঢাকার পার্শ্ববর্তী থানাগুলোতে। সিমনের কোনো সন্ধান নেই। ২৯ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারন ডায়েরি করেন সাইফুল।
ওই দিন দুপুর ২টার দিকে অজ্ঞাত নম্বর থেকে সাইফুলের মোবাইলে কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, ‘সাইফুলের একমাত্র ছেলে তাদের হাতে। তাকে অপহরণ করা হয়েছে। ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে সাইফুল তার ছেলেকে ফিরে পেতে পারে। পুলিশকে জানালে বা কোনোরকম চালাকি করলে ছেলের লাশের খোঁজও পাবে না সাইফুল’।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সাইফুলের। দুই হাজার টাকা যোগাড় করার সাধ্য নেই যার, তিনি কীভাবে যোগাড় করবে ২০ লাখ টাকা! পুরো বিষয়টি মোবাইল ফোনে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এসি সালমান হাসানকে জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সাইফুল।
এ ঘটনা জানার পর তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার অপহৃত সিমন উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বাসায় না ফেরার নির্দেশ দেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুক, এসি সালমান হাসান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রশীদকে।
পুলিশকে জানানোর বিষয়টি অপহরণকারীরা জানতে পারলে সিমনকে মেরে ফেলতে পারে এই ভয়ে পুলিশের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে চাচ্ছিলো না অপহৃত সিমনের বাবা সাইফুল। পুলিশ তার সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করার এক পর্যায়ে সাইফুল ভয়ে তার মোবাইলফোন বন্ধ করে ফেলে।
এসি সালমান হাসান বার বার অপহৃত সিমনের বাবা সাইফুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়ে পজিটিভ রেসপন্স না পেয়ে এবং এক পর্যায়ে সাইফুলের মোবাইল বন্ধ পেয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই মার্গুব তৌহিদকে নির্দেশ দেন অপহৃতের বাবা সাইফুলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য।
ওই দিন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাইফুল যে নিখোঁজ জিডি করেছিল, সেই জিডিতে উল্লেখিত সাইফুলের ঠিকানার সূত্র ধরে তেজগাঁও শিল্পানচল থানা পুলিশ সিভিলে নিজেদেরকে সাইফুলের আত্নীয় পরিচয় দিয়ে তার বাসায় উপস্থিত হয়।
পুলিশকে জানানো হলে সিমনকে অপহরনকারীরা মেরে ফেলবে জানিয়ে সাইফুল অপহরণকারী যে মোবাইল নম্বর থেকে তাকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করেছে সে মোবাইল নম্বর পুলিশকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
সাইফুল ও তার স্ত্রীকে থানার আশেপাশে নেয়া হবে না ও পুলিশকে জানানো হয়েছে এ বিষয়টি অপহরণকারী জানবে না বুঝিয়ে আশ্বস্ত করে করা হয় সাইফুল ও তার স্ত্রীকে। আত্নীয় পরিচয় দিয়ে বাসার আশেপাশের কাউকে বুঝতে না দিয়ে অপহৃত সিমনের বাবা-মাকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন বেগুনবাড়ি এলাকায় একটি বাসায় নিয়ে আসে পুলিশ।
পুলিশের পরামর্শে অপহরণকারীদের সঙ্গে মোবাইলে মুক্তিপণের বিষয়ে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যেতে থাকে সাইফুল ও তার স্ত্রী। সামান্য হেরফের হলেই প্রতি মুহূর্তে অপহৃত সিমনের ছিন্নভিন্ন লাশের হুমকি।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এসি সালমান হাসানসহ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার একটি টিম রাত ২টা ৩৮ মিনিটের দিকে হাতিরঝিল এলাকা থেকে রোমান নামে অপহরনকারী চক্রের একজন সদস্যকে গ্রেফতার করে।
রোমানের স্বীকারাক্তি অনুসারে ঢাকা জেলার কেরানীগনজ থানাধীন আটিবাজার এলাকা থেকে মানিক নামের অপহরনকারী চক্রের আর একজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
মানিকের স্বীকারোক্তি অনুসারে রাত অনুমান ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে তেজগাঁও থানাধীন বিজয় স্বরণী এলাকার পিরমা মসজিদের গলির পাশের খোলা মাঠ থেকে অপহৃত সিমনকে উদ্ধার করা হয়। অপহৃত শিশুটিকে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অচেতন করে রেখেছিল অপহরণকারীরা।
গ্রেফতারকৃত অপহরণকারীদের দেয়া তথ্য অনুসারে ওই রাতেই মোহাম্মদপুর, শেরে বাংলানগর ও মহাখালী ও বিজয় স্বরণী এলাকা থেকে অপহরনকারী চক্রের নারী সদস্যসহ বাকি ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এ বিষয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। উৎস: যুগান্তর।