পদ্মায় ভাঙন: নড়িয়ায় হাজারো পরিবার গৃহহীন, দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি
ডেস্ক রিপোর্ট: পদ্মার ভাঙনে গত এক মাসে হাজারো পরিবার গৃহহীন হয়ে গেছে। প্রতিদিনেই বাড়ি-ঘরসহ নতুন নতুন স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে পদ্মার করাল গ্রাসে। ওই এলাকার মানুষের কাছে এখন পদ্মানদী আতঙ্কের নাম।
গেলো পাঁচ দিনে নড়িয়ায় শতাধিক বাড়ি-ঘর স্কুল মসজিদ মাদ্রাসা পদ্মায় হারিয়ে গেছে। বাঁশতলা থেকে মূলফৎগঞ্জ পর্যন্ত চার কিলোমিটার পাকা সড়ক, ৩টি মসজিদ নদীগর্ভে চলে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে সুরেশ্বর-নড়িয়া সড়ক যোগাযোগসহ সকল যোগাযোগ।
মারাত্মক ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে মুলফৎগঞ্জ বাজার, নড়িয়া বাজার, পূর্ব নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেয়া হয়েছে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর মালামাল। পদ্মার তীরবর্তী লোকজনের চোখে কোন ঘুম নেই। অনেকেই খোলা আকাশের নিচে রাস্তার পাশে মানবেতর জীবন যাবত করছে। অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছে ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ। সরকারি কোন কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের।
কেদারপুর ইউনিয়নের মেম্বার মো. রফিক কাজী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বর্ষা মৌসুম শুরু থেকে নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার ১৫টি গ্রামে ব্যাপকভাবে পদ্মা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত পাঁচ দিনে নড়িয়ায় উপজেলার সাধুর বাজার, শুভগ্রাম, পাচঁগাও, চন্ডিপুর, ওয়াপদা, শেহের আলী মাদবর কান্দি, ঈশ্বর কাঠি, চরজুজিরার নজরুল দেওয়ান, হাসেম দেওয়ান, খোকন খান, তোতা খান, কালাম খান, নাছির মাদবর, সোনামিয়া, রহমান মাদবর, রুবেল দেওয়ান, আতাহার খান, আজিজুল মুন্সি, মাহবুব দরজী, আলমগীর বেপারী, মাসুদ দেওয়ান, জাবেদ দেওয়ান, ওসমান ঢালী, সিরাজ ঢালী, আবুল ঢালী, ধলু খালাসী, দুলাল মাদবর, আলম ভুইয়া, সামসুদ্দিন ভুইয়া, কৃষ্ণ মাষ্টার, হারুন খান, গুপি দাস, কার্তিক মেম্বার, মতি মাষ্টার, আকবর দেওয়ান, মোকলেছ দেওয়ান, সোহান দেওয়ান, ঈমাম হোসেন হাওলাদার, জামাল বেপারী, মজু মিয়া, লোকমান হাওলাদার, আলী হেসেন বেপারী, জসিম বেপারী, মোস্তফা হাওলাদার, নুর মোহাম্মদ বেপারী, হাসেম হাওলাদার, মোবারক হাওলাদার আয়নাল বেপারী, ঈমাম হোসেন দেওয়ান, নুর হোসেন দেওয়ান, মুন্নি খান, কামাল দেওয়ান, ইন্দ্রজিৎ, চৈতা, লোকমান দরজী, আবুল বাশার দেওয়ান, জয়নাল দেওয়ান, এসকান্দর দেওয়ান, মুজাফ্ফর দেওয়ান, সাগর দেওয়ান, দেলোয়ার খান, আঃ রব দরজী, ওসমান ঢালি, মাহবুব দরজী, হাসেম হাওলাদার, দিদার খান, আজিজুল মুন্সি, আলমগীর বেপারী, বাদশা দেওয়ান, এসহাক ঢালি, সিরাজ ঢালি, মালাবক্স ঢালি, আবুল ঢালি, মাজহার বেপারী, পজর হাওলাদার, লালু ভুইয়া, আলম ভুইয়া, রাজ্জাক বেপারী, জুলহাস বেপারী, হারুন খানসহ শতাধিক লোকের বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে গেছে।
এছাড়াও বায়তুল করিম জামে মসজিদ, গাজী কালু জামে মসজিদ, পাচঁগাও জামে মসজিদ ও ৬টি ব্রিজ পদ্মা নদীর করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে।
পূর্ব নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে কিছু কিছু জাগায় ফাটল দেখা দিয়েছে। স্কুলের মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। স্কুলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৮ আগস্ট রাতে পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যায় নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কের মূলফৎগঞ্জ বাজার সংলগ্ন খান বাড়ি জামে মসজিদ ও হযরত খাঁজা মঈন উদ্দিন চিশতীর অনুসারী গাজী কালুর(চার তলা ভবন)মেহমান খানা ও দিলু খানের দোতলা ভবন ও খান বাড়িটি।
এদিকে নড়িয়া বাজার থেকে মাত্র ২০০ গজ এবং মুলফৎগঞ্জ বাজার থেকে মাত্র ২৫ গজ দূরে নদী চলে আসায় মুলফৎগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ও পার্শ্ববর্তী বাড়ির লোকজন প্রতিটি মুহূর্ত ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর দাবী, ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এখনও নড়িয়া বাজার রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। তারা বলছেন, নড়িয়ায় নদী ভাঙনের কারণে মহা দুর্যোগ চলছে। শত শত মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে খোলা আকাশের নিচে দিন যাপন করছে। এ কারণে এই এলাকাকে দুর্যোগ এলাকা ঘোষণা করে সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তা দেয়া হোক।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, পদ্মার (ডান) তীর রক্ষা বাধ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমের পূর্বে পদ্মা নদীর তীর রক্ষা বাধের কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবীতে এলাকাবাসী মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করলেও কোন কাজ হয়নি। ভাঙন শুরু হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর গতি পরিবর্তনের জন্য তাৎক্ষনিক ভাবে ৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে কিছু জিওব্যাগ ফেলে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাতেও কোনও লাভ হয়নি।
কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ঈমাম হোসেন দেওয়ান বলেন, গত ৩ মাসে পদ্মার ভাঙনে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। কোনও জনপ্রতিনিধি সরকারি কর্মকর্তা কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা করেনি। এলাকায় মহাদুর্যোগ চলছে। সরকারের কাছে দাবী এ এলাকাকে দুর্যোগ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে সার্বিক সহায়তা দেয়া হোক।
পদ্মার ভাঙনে ঘরবাড়ী হারানো বাদশা দেওয়ান, নুর হোসেন দেওয়ান, সাগর দেওয়ান বলেন, গত ৫ দিনে ভয়াবহ ভাঙনে আমাদের ঘরবাড়ি বসত ভিটাসহ প্রায় শতাধিক বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। অনেকেই খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। সরকারি তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কিছু জিওব্যাগ ফেলেছি। তাতে নদী ভাঙার গতি থামেনি। ভাঙন রোধে খুব শীঘ্রই পদ্মার দক্ষিণ তীর রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হবে।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, প্রতি দিনই পদ্মায় নতুন নতুন বাড়িঘর, জায়গা জমি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট তলিয়ে যাচ্ছে। আমি সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। পদ্মার তীরবর্তী লোকজনদের দূরত্ব বজায় রাখতে মাইকিং করা হয়েছে। ইতোপূর্বে ১ হাজার ৪শ’ জন ক্ষতিগ্রস্তদের শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সূত্র: আরটিভি অনলাইন