ভালোবাসি বলেই অন্য মেয়েকে ওর বউ করে আনবো : কাজল হিজড়া
মধ্য বাড্ডার একটি তিনতলা বাড়ির দোতলায় থাকেন কাজল সিকদার। সরু গলি পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। বাবা-মা, দুই ভাই ও দুইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তবে কাজল নিজের সংসারে একাই। আর তাই নিজের ঘরটিকে সাজিয়ে রেখেছেন ছিমছাম নিজের মতো করে। দৃশ্যত কাজল ‘নারী’ হলেও তিনি মূলত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ (হিজড়া)।
৩০ বছর বয়েসী এ মানুষটি ‘হিজড়া পেশার’ পাশাপাশি সংখ্যালঘু এ সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়েও কাজ করছেন। যেমন ভালো নাচতে পারেন, তেমন পারদর্শী অভিনয়েও। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের ফ্যাশন শোসহ তিনটি জাতীয় ফ্যাশন শোতে অংশ নিয়েছেন। অভিনয় করেছেন ১৫টির মতো পথ নাটকে। হিজড়াদের নিয়ে গঠিত ‘সম্পর্কের নয়া সেতু’ নামক সংগঠনের তিনি অর্থ বিষয়ক সম্পাদক।
অন্যসব সাধারণ মানুষের মতো হিজড়াদের জীবনেও রয়েছে প্রেম-ভালোবাসা-ভালোলাগা। তবে তাদের এই প্রেমের ভবিষ্যৎ কারো জানা নেই।আপনারও কি বয়ফ্রেন্ডও আছে? কাজল হিজড়াকে করা এমন প্রশ্নে সরাসরি উত্তর তার।
হুম…আছে। অনেকদিন ধরে আমি তার সঙ্গে প্রেম করি। তার সঙ্গে আমার পরিচয় খুব নাটকীয়ভাবে। আমরা হিজড়ারা যখন বের হতাম, তখন সে প্রতিদিন আমাকে ফলো করতো। আমরা যেখানে থাকতাম, ওখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। একদিন ডেকে কথা বলে জানা গেলো, সে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। আমাকে পছন্দ করে। তারপর একদিন দুইদিন করে একসময় ওর সঙ্গে গভীর প্রেমে জড়িয়ে গেলাম। একসঙ্গে ছিলামও অনেক দিন। এখন সে মালয়েশিয়াতে থাকে। কয়েকদিন পরেই ফিরবে।
তবে তার এই প্রেমের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলেও জানান। বলেন, আমি চাই না, আমার জন্য ওর জীবন নষ্ট হোক। এইবার ফিরে এলে আমি ওকে বিয়ে করাবো। একটা সুন্দরী মেয়েকে ওর বউ করে আনবো। এতে আমার কষ্ট হবে ঠিক। কিন্তু আমি যেহেতু ওকে সত্যিকারের ভালোবাসি, এ ছাড়া আর কী করতে পারি। আমাদের জীবন তো এভাবেই কেটে যাবে। ও বিয়ে করলেও আমি ওকে ভালোবেসে যাবো। একটা কথা বলে রাখি, ওর সঙ্গে আমার প্রেমের কথা ওর পরিবারও জানতো। এজন্য ওকে পরিবারে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু ও আমাকে এতোই ভালোবাসে যে, কিছুতেই আমাকে ছাড়তে রাজি না। পরিবারের লোকজন ভেবেছিলো তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিলে হয়তো আমার প্রতি টান কমে আসবে। কিন্তু অনেকদিন হলো সে বিদেশে। কোনোভাবেই আমাদের প্রেমে এতটুকু ঘাটতি হয়নি। মাঝে একবার দেশে এসেছিলো। তখনও আমরা একসঙ্গে ছিলাম। ও যদি কাউকে বিয়েও করে, তাহলেও আমাদের প্রেম থাকবে।
তিনিআরও জানান, অনেক হিজড়াই প্রেম করে। তারা তো মেয়েদের মতোই। ছেলেদের প্রতি তাদের ভালোলাগা, ভালোবাসা কাজ করে। হ্যাপি নামে আমার একটা হিজড়া বান্ধবী এক ছেলের এতোটাই প্রেমে পড়েছিলো যে, ছেলেটা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পরে হ্যাপি তার শরীর কেটে ফেলেছিলো। পরে সে আরেক ছেলের প্রেমে পড়েছিলো। সে ছেলের সঙ্গে যখন ব্রেকআপ হয়ে যায়, তখন হ্যাপি তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এমন আরও অনেক প্রেমের গল্প আছে। তবে এটা সত্যি, অনেক ছেলেরাই হিজড়াদের সঙ্গে সাময়িক প্রেম করে। কেউ স্থায়ী প্রেম করে না। এতে হিজড়ারা অনেক কষ্ট পায়। অনেক ছেলে তো টাকা পয়সাও হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনা প্রচুর আছে।
কাজলের মতে, আমাদের জীবনই তো কষ্টের। এখনওতো কতো কষ্ট হয়। প্রায় রাতে যখন একা একা ঘুমাতে যাই, তখন ভাবি আমি তো আসলেই একা। এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। সবাই আমাদেরকে অন্যভাবে দেখে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখি চারপাশের সব বাড়িতে সুন্দর সংসার পাতানো আছে। কিন্তু আমার কোনোদিন সংসার হবে না। আমাকে একাই থাকতে হবে সবসময়। এটাই আমার নিয়তি।
এছাড়া পথে ঘাটে প্রায়ই আমাকে বিব্রত হতে হয়।বলেও জানান তিনি। বলেন, আমি উত্তরায় একটা চাকরি করতাম। আর সব মেয়েদের মতোই সুন্দরভাবে অফিস করতে যেতাম। কিন্তু আসা যাওয়ার পথে মানুষের বিকৃত দৃষ্টি আমাকে কষ্ট দিতো। বাসে মহিলাদের সিটে বসলে পাশের মহিলারা অন্য চোখে তাকাতো। এতেও তো কম কষ্ট পেতাম না। কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি, বেঁচে থাকতে হবে।