জেদ্দা হজ্ব টার্মিনালে নামার পর হজ্বযাত্রীদের করণীয়
জেদ্দা হজ্ব টার্মিনাল। সারা বিশ্ব থেকে আসা হজ্বযাত্রীরা জেদ্দার বিমান বন্দরের হজ্ব টার্মিনালে এসে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন।
জেদ্দা শহরের পুরানো বিমান বন্দরটি একসময় জেদ্দা শহরের একদম কাছাকাছিই ছিল। এ বিমান বন্দরেই হজ্ব টার্মিনাল ছিল। তবে এখানে ঐ সময় ছিল না আধুনিক সুযোগ সুবিধা ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। ১৯৮৩ সাল থেকে সৌদি আরবে বাদশাহ আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর চালু হয়। এখানে রয়েছে বিশাল হজ্ব টার্মিনাল। এছাড়াও রয়েছে রাজকীয় পরিবারের জন্য প্রিন্স টার্মিনাল তথা ভি.ভি.আই.পি টার্মিনাল, সৌদি এয়ারলাইন্স আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল এবং বিদেশি এয়ার লাইন্স টার্মিনাল।
বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে হজ্বের উদ্দেশ্য এ বিমান বন্দরে অবতরণ করলে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে হজ্ব টার্মিনালে। ১৯৮৩ সাল থেকে এখানে ছিল দুই তলা বিশিষ্ট লম্বা আকৃতির বিশাল টার্মিনাল ভবন, ছিল ১২ টি গেইট। এ গেইটগুলো দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজীরা প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতেন। অতঃপর গেইটের অপর প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে যেতেন। কিন্তু গত ১০/১২ বছর থেকে তারা এ ১২ টি গেইটের সিস্টেমটা পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে এখন আগের মত যে কোন গেইট দিয়ে হজ্ব টার্মিনালে প্রবেশ করলে বিশ্বের বড় বড় আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরগুলোর মত হজ্বযাত্রীগণকে একই এরিয়ায় নিয়ে আসা হয়। তবে বর্তমান টার্মিনাল ভবনে আধুনিকতা হজ্বযাত্রীগণের যথাযথ নয়। টয়লেট সংখ্যা খুবই কম,ব্যবহার পদ্ধতিও সহজ নয়। ফলে দীর্ঘ যাত্রার পর হজ্বযাত্রীগণ হজ্ব টার্মিনালে প্রবেশ করে টয়লেট ব্যবহার নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। এখানে শীতাতপ ব্যবস্থা খুবই কড়া। আমাদের দেশের মত অনভ্যস্ত হাজীরা ঠাণ্ডা অনুভব করে। এহরাম পরিহিত হলে এসির ঠাণ্ডায় আরও কষ্ট পাওয়া স্বাভাবিক। এখানে রয়েছে বিশেষ স্টিকার লাগানোর ব্যবস্থা। যা সৌদি কর্তৃপক্ষ সরবরাহকৃত কাফেলা এজেন্সির সহযোগিতায় হাজীদের পাসপোর্টে পিন দিয়ে লাগানো থাকে। দেশ থেকে কাফেলা এজেন্সি ফরম পূরণ করে দিলেও হজ্ব টার্মিনালে প্রবেশ করে এদিক সেদিক করতে হয়। নতুবা সেখানে গিয়ে নতুন ফরম পূরণ করতে হয়। এখানে প্রথমেই ইমিগ্রেশন, এখানে সময় নেয়। ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তুলা ,দুই হাতের আঙ্গুলের ছাপ নেয়া এসব কিছুতে সময় নেয়। অতঃপর নিতে হবে লাগেজ। লাগেজ নিয়ে যাওয়ার সময় কাস্টমস অতিক্রম করলে আরেক কাউন্টার। এখানে রয়েছে হজ্ব উপলক্ষে বিভিন্ন বাসের টিকেট লাগিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা। তা করে টার্মিনাল ভবন পার হতেই বড় বড় ট্রলি নিয়ে বিশেষ পোশাক পরা সেবকরা দাঁড়িয়ে আছে। এই সেবকদের অধিকাংশ মিশরীয়। হজ্ব উপলক্ষে কয়েক মাসের চুক্তিতে আগত। এ ট্রলীগুলোতে হজ্বযাত্রীগণের বড় বড় লাগেজ নিয়ে নিবে। একেক ট্রলীতে ২০/৩০ হজ্বযাত্রীর বড় বড় লাগেজ নেয়া যায়। ব্যাটারী চালত গাড়ি দ্বারা ট্রলী টেনে টেনে যে দেশের হজ্বযাত্রী সে দেশের হজ্ব মিশনে পৌঁছে দিবে। হাজীরা ট্রলিকে অনুসরণ করে হেঁটে হেঁটে হজ্ব মিশনে পৌঁছাবেন।
টার্মিনাল ভবন পার হলেই প্রায় ৫০/৬০ ফুট উচ্চতায় বিশেষ তাঁবু আচ্ছাদিত হজ্ব টার্মিনালের বহিরাঙ্গন। এখানে রয়েছে বিভিন্ন দেশের হজ্ব মিশন, ব্যাংক, সৌদি হজ্ব দপ্তরের অফিস, হাজীদের বাস নিয়ন্ত্রণের দপ্তর, হজ্বের পর দেশে ফিরতে বিভিন্ন এয়ার লাইনের অফিস, রেস্টুরেন্ট, টয়লেট ইত্যাদি। প্রায় ১ কি.মি দৈর্ঘ্য, আধা কি.মি প্রস্থ এরিয়ায় হাজার হাজার হজ্বযাত্রীর আনাগোনা থাকলেও এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। এখন গরমের সময় হজ্ব। তথা জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বরে প্রচণ্ড গরম। তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে থাকে।
এখানে সরকারি বেসরকারি সৌদি বিমান,বাংলাদেশ বিমানের যাত্রীদের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই। বাংলাদেশি হজ্ব মিশন তথা হজ্ব প্লাজায় পৌঁছালে হজ্ব মিশনের সেবকেরা হজ্বযাত্রীদের হাত থেকে পাসপোর্টগুলো নিয়ে বাস কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়ে দেয়। বাস কর্তৃপক্ষ হাজীদের সংখ্যা অনুপাতে বাস সরবরাহ করতে থাকবে। বাংলাদেশের একেকটি ফ্লাইটের যাত্রীর জন্য ৮/১০ টি বাস লাগে। হজ্ব টার্মিনালের অভ্যন্তরে রয়েছে শত শত বাস। এখানকার বসার ব্যবস্থা যথাযথ নয়। প্লাস্টিকের বড় বড় হেলানী বেঞ্চ। তা আবার হাজী সংখ্যা অনুপাতে কম। অনেক সময় হাজীরা হেলানী বেঞ্চের সংকুলানের অভাবে ফ্লোরে বসতে বাধ্য হন। টয়লেটগুলো যথাযথ নয়। হজ্ব টার্মিনালের বহিরাঙ্গনের কিছুটা দূরত্বে শক্তভাবে দেওয়াল কাটা তারের বেড়া দেয়া আছে। এ টার্মিনাল ভবন থেকে প্রায় ১ কি.মি মতো দূরত্বে গেইটে রয়েছে কড়া চেকপোস্ট। রয়েছে কড়া নজরদারী। ফলে যথাযথ ডকুমেন্ট না থাকলে প্রবেশ করা বা বের হওয়া সম্ভব হবে না। দেশ থেকে এহরাম পরিহিত হলে আপনাকে দেয়া হবে মক্কা শরীফের গমনের বাস। এহরামবিহীন হলে দেয়া হবে মদিনা শরীফে গমনের বাস। বাস প্রদানে হয় তারতম্য। আমাদের মত গরীব দেশের হাজীদেরকে পুরাতন বাসগুলো দেয়া হয়। ফলে ৪০/৫০ জন হজ্বযাত্রীর বড় বড় ব্যাগগুলো বাঁধা হয় বাসের ছাদের উপর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথ নয়। পথে বৃষ্টি পড়লে ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। জেদ্দা বিমান বন্দরের হজ্ব টার্মিনালে প্রবেশ করে বহিরাঙ্গনে এসে বাসে উঠে কোন এক পবিত্র নগরীর উদ্দেশ্য রওনা হতে ৩/৪ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় নেয়। এতে হাজীরা গরমে ছটফট করতে থাকে।
হজ্বের পর জেদ্দা হজ্ব টার্মিনালে হজ্বযাত্রীগণকে রিপোর্ট করতে হবে বিমান ছাড়ার ৮ ঘন্টা আগে। এ সময় টার্মিনালের বহিরাঙ্গনে প্রচন্ড গরমের মধ্যে অবস্থান নিতে হবে। সৌদি এয়ার লাইনের হাজী হলে কাউন্টার খুললে ঐখানে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। তেমনিভাবে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটের কাউন্টার খুললে হাজীদেরকে লাগেজ নিয়ে রিপোর্ট করতে আসতে হবে।
হজ্বের পর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত প্রতি ফ্লাইটে ৪১৯ জনের মত হাজী আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিমানকে লাগেজ দিয়ে বোয়িং কার্ড নেয়া খুবই কষ্টসাধ্য। বোয়িং কার্ড নেয়ার পর ইমিগ্রেশন সমাপ্ত করে বিমানে উঠার গেইটের আগে অপেক্ষমাণ কক্ষে পৌঁছতে হবে। এর আগে সোয়া চারশত হাজীর চলবে কড়া তল্লাশী। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে হবে। সৌদি নিরাপত্তা তল্লাশি অতিক্রম করে গেইটের আগে অপেক্ষমান কক্ষে পৌঁছতে হবে। এখানে অবস্থাভেদে ৩/৪ ঘন্টা অথবা তারও বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে। এখানে কিনে খাওয়ার একটা দুইটা কুলিং কর্ণার থাকলেও তা যথাযথ নয়। রয়েছে হজ্বযাত্রী অনুপাতে টয়লেট স্বল্পতা। ঘোষণা হলে এখান থেকে সরাসরি গিয়ে বিমানে আরোহণ করতে হবে। বর্তমানে হজ্ব সিজনের পর সারা বছর ওমরাকারী যাওয়া আসা করে। তাদেরকেও সৌদি কর্তৃপক্ষ সরাসরি টার্মিনালের মাধ্যমে যাওয়া আসা করাচ্ছে। অপরদিকে পবিত্র মদিনা বিমান বন্দর হজ্ব টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। সৌদি কর্র্তৃপক্ষ চাচ্ছে যারা হজ্বের আগে মদিনা শরীফে যেতে চান তারা যেন জেদ্দা না নেমে সরাসরি পবিত্র মদিনার বিমান বন্দরে নামে। আর যারা হজ্বের আগে পবিত্র মক্কায় গিয়ে হজ্বের পর পবিত্র মদিনা যাবেন তারা দেশে রওনা হতে যাতে পবিত্র মদিনা বিমান বন্দর থেকে দেশে রওনা হন।
কিন্তু বাংলাদেশ বিমান গত বছর পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরে কয়েকটি ফ্লাইট পরিচালনা করলেও এখনও পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছে না। বর্তমান সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ বরাবরে তিনটি বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। সরাসরি রিয়াদে,ঢাকা সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে এবং মক্কা শরীফে সৌদি হজ্ব ও ওমরা মন্ত্রীর মাধ্যমে। এ তিন বিষয় হল: ১. হজ্বযাত্রী যেহেতু দেশওয়ারী কোটা নির্ধারিত করা আছে, কাজেই কোটার ভিতর থেকে একাধিক বার হজ্ব করলে দুই হাজার রিয়াল করে সৌদি সরকার যে জরিমানা নিচ্ছে তা ফেরত দেয়া। ২. পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারমের একদম নিকটে তিনটি বিলাস বহুল হোটেল রাজকীয় প্রাসাদ সরিয়ে মসজিদুল হারমের চারপাশে আরও সম্প্রসারণ করে বিশাল আকৃতির চত্ত্বর রাখা। অতঃপর হোটেলাদি ও রাজকীয় প্রাসাদ থাকবে। ৩. জেদ্দা হজ্ব টার্মিনাল সম্প্রসারণ করা। জেদ্দা হজ্ব টার্মিনালটি হজ্বযাত্রীর জন্য কষ্টদায়ক, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হজ্বযাত্রীরা এখানে যথাযথ সুযোগ সুবিধার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসএস