তারা মসজিদ: নন্দন ও ঐতিহ্যে আজও ভাস্বর
---
অনলাইন ডেস্ক : মসজিদের শহর ঢাকায় সেই প্রাচীনকাল থেকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মসজিদ। প্রতিটি মসজিদের রয়েছে নানান ইতিহাস, নানান গল্প। তার মাঝে অনেক গল্পই হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে। কিন্তু মসজিদগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দন এসব মসজিদগুলোর পরিচিতিও আমাদের অনেকেরই জানা নেই। ঢাকা শহরের বিখ্যাত মসজিদগুলোর মাঝে তারা মসজিদ একটি। এই মসজিদের সৌন্দর্যের কথা শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া ভার। পুরান ঢাকাতেই এর অবস্থান। প্রাচীন এই মসজিদটি দেখতে হলে আরমানিটোলার ৬/৩ আবুল খয়রাত সড়কে চলে যেতে হবে।
তারা মসজিদ পুরানো ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত। ঝকঝকে সাদা মার্বেলের উপরে নীল তারারা ব্যতিক্রম করেছে মসজিদটিকে অন্য যেকোনো মসজিদ থেকে। সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত হয়ে নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে এ মসজিদটি। মসজিদের গায়ে নির্মাণ তারিখ খোদাই ছিল না।
জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদে আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর। যার আসল নাম মির্জা আহমদ জান। আর মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদের নামই রাখা হয় পরে আরমানিটোলা হয়। মির্জা আহমদ জান ছিলেন ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি। মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়।
১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে ১৯২৬ সালে, ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে। মোঘল স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব রয়েছে এ মসজিদে। ঢাকার কসাইটুলীর মসজিদেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য, দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরের সতের শতকে নির্মিত স্থাপত্যকর্মের ছাপ পড়ে মোঘল স্থাপত্য শৈলীতে। [স্থাপত্য: বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-২, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।]
তারা মসজিদের সামনের মনোরম দৃশ্য।
মির্জা গোলামের সময় মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজওয়ালা, দৈর্ঘ্যে ৩৩ ফুট বা ১০.০৬ মিটার এবং প্রস্থে ১২ ফুট বা ৪.০৪ মিটার। আলী জানের সংস্কারের সময়, ১৯২৬ সালে, মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজের তারা মসজিদকে পাঁচ গম্বুজের মসজিদে রূপান্তর করা হলে মসজিদটি দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়। অবশ্য প্রস্থে কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয়নি। বর্তমানে সম্প্রসারিত মসজিদের দৈর্ঘ্য ২১.৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ৭.৯৮ মিটার। পাঁচ গম্বুজের মসজিদে পরিবর্তন করার প্রয়োজনে একটি মিহরাব ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং দুটি নতুন গম্বুজ ও তিনটি নতুন মিহরাব যুক্ত করা হয়। মসজিদের জুল্লায় প্রবেশের জন্য পাঁচটি খিলানবিশিষ্ট পথ সৃষ্ট করা হয়েছে। [ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, মুনতাসীর মামুন।]
এ খিলানগুলি বহু খাঁজবিশিষ্ট এবং চারটি অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ হতে উত্থিত। মসজিদের অভ্যন্তরে ও বাইরে সম্পূর্ণরূপে মোজাইক নকশা করা। এ গাত্রালংকারে চিনামাটির প্লেট, পেয়ালা ইত্যাদির ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরা ব্যবহৃত হয়েছে। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি টিকরী’ বা চিনি দানার কাজ বলা হয়। ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, এক বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র ও আরবি ক্যালিগ্রাফিক লিপি মসজিদের গাত্রনকশায় বিধৃত হয়েছে। এ মসজিদের অলংকরণ জুল্লার অভ্যন্তরে ফুলদানি থেকে উত্থিত ফুলগাছ, খিলান শীর্ষে পেন্ডেন্টিভের উপর ও দেয়ালগাত্রে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। বারান্দায় গাত্রালংকারে জাপানের বিখ্যাত ‘ফুজিসান’- এর দৃশ্যসম্বলিত গ্লেস টাইল উল্লেখযোগ্য। ‘ফাসাদ’ এর কেন্দ্রে আরবি লিপি সম্বলিত সূক্ষ্ম অর্ধচন্দ্র ও তারার অলংকরণ স্থান পেয়েছে। বৃত্তাকার শ্বেত-শুভ্র গম্বুজগুলিতে বসানো হয়েছে নীল রঙের অসংখ্য তারা বা নক্ষত্র। সমগ্র নকশায় সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে তারার ‘মোটিফ’; তাই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে খ্যাত।
মসজিদের বতর্মান দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)। ২০১৫ সালে একবার নৌ-মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ফলে আরও ২১টি স্থাপনার সাথে ‘তারা মসজিদ’ও ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পরে আর সেটা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
তারা মসজিদের ভেতরের মনোরম দৃশ্য।
যদিও পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি গলি আর কোলাহলের ভিড়ে দর্শনার্থীদের তারা মসজিদ খুঁজে পেতে একটু মুশকিলই হয়। তবে এর সামনে দাঁড়ালে মনের বিরক্তিগুলো কর্পূরের মতো উড়ে যাবে। দর্শনার্থীর মনে ভর করে প্রশান্তির শ্যামল ছায়া। এর কারুকাজমণ্ডিত দেয়াল আর গম্বুজগুলো চোখের সামনে মুঘলদের সৌন্দর্যপিপাসু মনের কথাই ঘোষণা করে। মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে গেলে সামনের খোলা মাঠে প্রথমেই তারা আকৃতির একটি ফোয়ারা রয়েছে। এর চারদিকে সবুজ ঘাসের ওপর মোজাইক টাইল দিয়ে নামাজিদের মসজিদে যাওয়ার রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। এগুলো এর সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়েছে। এর পাঁচটি গম্বুজের গায়ে ও ভেতরের ডিজাইনগুলো দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। লতাপাতা আর বিভিন্ন ফুলের সমাহারে মন হারিয়ে যাবে মুঘল আমলে। মুগ্ধ নয়নে কারুকাজগুলো দেখতে দেখতে আপনার মনে হতে পারে, আপনি কোনো মুঘল বাদশাহর দরবারে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রতিদিন ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকার শতশত দর্শনার্থী এটির সৌন্দর্য অবলোকন করে মুগ্ধ হন। প্রতি ওয়াক্তেই এখানে প্রায় শতাধিক নামাজি নামাজে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার এই স্থাপনাটি কেন্দ্র করে ৫ থেকে ৫০০ টাকা সিরিজের ব্যাংক নোট মুদ্রণ করে। বর্তমানে প্রচলিত ১০০ টাকা মূল্যমানের নোটেও রয়েছে পুরান ঢাকার এ নয়নাভিরাম স্থাপত্যটি। এছাড়া ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর এই মসজিদের ডিজাইনকে খাদি কাপড়ে ফুটিয়ে তুলে রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় খাদি ফ্যাশন শো। [দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬]
বর্তমানে মসজিদটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। মসজিদটির পাশেই রয়েছে মাদ্রাসা যার দেখাশোনাও মসজিদ কর্তৃপক্ষই করে থাকেন। বর্তমানে মাদ্রাসাটির মক্তবে ২ বেলা ২৫০ জন ছাত্র, হেফজখানায় ৪০ জন ছাত্র পড়াশোনা করছে আর শিক্ষক হিসেবে মক্তবে ৫ জন ও হেফজখানায় ২ জন দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে মসজিদটির স্থানীয় লোকজনদের নিয়ে গঠিত কমিটিই এর পরিচালনা করছে। পদাধিকারবলে এই কমিটির সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। মসজিদের উন্নয়ন ও বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকার তিন লাখ টাকা প্রদান করে। এদিকে প্রতি রমজানেই প্রতিদিন মসজিদ প্রাঙ্গণে গরিব এবং মুসাফিরদের জন্য এলাকাবাসী ও মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে ইফতারের আয়োজন করা হয়। সেখানে শত শত মানুষ একসঙ্গে ইফতার শেষে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন।