আন্তর্জাতিক ডেস্ক :ছোট্ট একটা এক লাইনের বার্তা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নাটকীয় ঘোষণায় ভারতের বাজার থেকে সব পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়ার পর দেশের অবস্থাটা বর্ণনা করার জন্য এর চেয়ে নিখুঁত ছবি বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না। তাই ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ বা মুঠোবার্তায় কথাটা ছড়িয়ে পড়েছিল ঝড়ের মতো।
আক্ষরিক অর্থেই, সারাদুনিয়া যখন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় হিলারি ক্লিন্টন বনাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলের দিকে নজর রাখছে, ভারতের কোটি কোটি গৃহস্থালিতে তখন আঁতিপাতি করে খোঁজা হচ্ছে বাড়ির কোথায় কটা পাঁচশো বা হাজারের নোট গুঁজে রাখা আছে! যাদের কালো টাকার সঞ্চয় আছে নগদ নোটে, কিংবা সম্প্রতি বাড়ি-গাড়ি বেচে উপার্জন করা বেশ কিছু অঘোষিত অর্থ বাড়ির সিন্দুকে বা তোষকের নিচে গুঁজে রাখা আছে, সত্যিই হাত পড়েছে তাদের মাথায়।
যে গৃহবধূরা স্বামীর অজান্তে তাদের পকেট থেকে টাকা সরিয়ে বা অন্য কোনোভাবে তিল তিল করে সঞ্চয় গড়ে তুলেছিলেন তারাও বাধ্য হয়ে ফাঁস করে দিচ্ছেন সেই টাকার থলি। কারণ প্রধানমন্ত্রী তো জানিয়েই দিয়েছেন, ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে জমা না-দিলে ওগুলোর দাম আর বাতিল কাগজের টুকরোর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
এ তো গেল ঘরের ভেতরের কথা। আর রাস্তাঘাটে, দোকানপাটে যে চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেছে, তার জন্য সরকার আগাম হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মানুষ তারপরও যেভাবে উদভ্রান্ত ও দিশেহারা আচরণ করছে, তা প্রায় ভাবাই যায় না।
সারাদেশে ব্যাংকের এটিএম মেশিনগুলোর সামনে লম্বা লাইন ছিল ভোররাত পর্যন্ত। কিন্তু তাতে একশো টাকার নোট ফুরিয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। তবু মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল মাত্র শ চারেক রুপি তোলার জন্য। যদি কড়কড়ে চারটে মহার্ঘ্য একশো রুপির নোট কোনোভাবে মিলে যায়।
কবি শ্রীজাত তো লিখেই ফেললেন, ‘‘হেলাফেলার একশো টাকার নোট বহুদিন বাদে আবার ফিরে পেয়েছে ‘রাজার পার্ট’!’
বলা হয়েছিল, পেট্রল পাম্প-হাসপাতাল-রেল স্টেশন-বিমানবন্দরে পাঁচশো বা হাজার রুপির নোট নেওয়া হবে আরও তিনদিন, অর্থাৎ ১১ নভেম্বর পর্যন্ত। কার্যত দেখা গেল তা নিয়ে খিটমিট শুরু হয়ে গেছে কাল রাত থেকেই। গাড়িতে সাতশো রুপির তেল ভরে হাজার টাকার নোট দিয়ে লোকে তিনশো রুপি ফেরত চাইছে, আর তা নিয়ে পেট্রল পাম্পে শুরু হয়ে যাচ্ছে তুমুল ঝগড়া। ওদিকে লম্বা লাইন পড়ে যানজট শুরু হয়ে যাচ্ছে পাম্পের সামনে। ওষুধের দোকানের অবস্থাও তথৈবচ।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেশের দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষগুলোর। তারা কেউ কেউ সারামাসের মাইনে পেয়েছেন হয়তো গুটিকয় পাঁচশো বা হাজারের নোটে। গত দু’বছর ধরে সরকারের ব্যাপক ক্যাম্পেইসের পরও তাদের অনেকেই হয়তো এখনও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেননি। ফলে সেই নোটগুলো নিয়ে তারা এখন কী করবেন, রোজকার বাজারপাতি কিভাবে হবে সেই দুশ্চিন্তায় তাদের রাতের ঘুম উধাও।
পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য কালোবাজারিরা সব সময়ই তৈরি থাকে। ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দেশের বহু জায়গা থেকে খবর আসছে, পানের দোকানে হাজার টাকার নোট বদলে দেওয়া হচ্ছে আটশো টাকায়। আটটা কড়কড়ে একশো টাকার নোটে। পাঁচশোর দর মিলছে চারশো, ফলে দোকানির মুনাফা নিট কুড়ি শতাংশ।
স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে ভরিতে অন্তত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি দিয়ে লোকে পড়িমড়ি করে নগদে গয়না কিনছে। গতকালের তারিখে পাকা রসিদও মিলছে হাতে হাতে। এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে।
তবে এগুলো যে হওয়ারই ছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা নিয়ে আগাম সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আর সেই সঙ্গেই আশা প্রকাশ করেছিলেন, দেশে কালো টাকা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বার্থে মানুষ নিশ্চয় সেটুকু মেনে নেবে। এখন পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, হাজারটা অসুবিধা হলেও দেশের কোথাও সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়নি বা মানুষ রাস্তায় নেমে স্লোগান দেয়নি।
তবে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এদিন সকালে টুইট করে দাবি করেছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ অসম্ভব কঠোর (ড্রাকোনিয়ান) ও তা প্রত্যাহার করতে হবে। তবে দেশের আর কোনও বড় বিরোধী রাজনৈতিক দল সেই দাবিতে গলা মেলায়নি, সম্ভবত এটা আঁচ করেই যে নরেন্দ্র মোদির এই সিদ্ধান্তে মোটের ওপর সাধারণ মানুষের সায় আছে। কালো টাকার অর্থনীতির চাপে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে-যাওয়া ভারত আশা করছে যে, এ রকম একটা কড়া দাওয়াই হয়তো কিছুটা হলেও দেশের ভোল পাল্টাতে পারবে।
এমন একটা নাটকীয় সিদ্ধান্তর পেছনে আসল মাথাটা কার, তীব্র জল্পনা চলছে তা নিয়েও। ভারতের জনপ্রিয় যোগগুরু বাবা রামদেব কয়েক মাস আগেই সংবাদমাধ্যমে এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে প্রমাণ আছে হাতের কাছেই। তবে আরও জানা যাচ্ছে, তারও আগে ২০১৪ সালে পুনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অর্থক্রান্তি সংস্থানে’র কর্ণধার অনিল বোকিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ব্যাখ্যা করেছিলেন, এই পাঁচশো ও হাজার রুপির নোট বাতিল করার সুফলটা কী। মাত্র দশ সিনিটের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে নরেন্দ্র মোদি নাকি শেষমেশ দু’ঘন্টা ধরে ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন তার কথা!
তবে বাবা রামদেব বা অনিল বোকিল–পরামর্শটা যিনিই দিন, দুঃসাহসী সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত যিনি নিয়িছেন, তার নাম অবশ্যই নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি।
সেই সিদ্ধান্তের জেরে ভারতে এখন একটা চরম বিশৃঙ্খলা চলছে ঠিকই–এতে কালো টাকার অর্থনীতি কতটা কাবু হবে, তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দিহান। কিন্তু এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে যে সত্যিকারের বুকের পাটা লাগে, দেশি-বিদেশি মিডিয়া থেকে ভারতের আমজনতা তা কবুল করছে নিঃসংকোচে!