আনিসুল হক : এর আগে লিখেছিলাম, মেসির কান্না। কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনার হারের পর মেসি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। এবারের রিও অলিম্পিকে ফুটবলের সোনা জয়ের পর কান্না থামাতে পারছিলেন না ব্রাজিল অধিনায়ক। এরপর প্রথম আলো অনলাইনে লিখলাম, ‘নেইমারের কান্না, মেসির কান্না’। আজ লিখতে হচ্ছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কান্না নিয়ে।
টেলিভিশনের খবরে হঠাৎই দেখলাম, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল কাঁদছেন। ২৩ আগস্ট ২০১৬ প্রথম আলো অনলাইন লিখেছে, ‘দলের নেতা-কর্মীদের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করার সময় কেঁদে ফেললেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ‘আজ মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে “৩০টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল” বন্ধের প্রতিবাদ জানাতে অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (অ্যাব) আলোচনা সভায় বক্তব্য দেওয়ার একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন ফখরুল।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রতিদিন ক্রসফায়ার-একটা, দুটা, তিনটা, চারটা চলছে। যতজনকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, একটা লোক বেঁচে আছে? সবাইকে ক্রসফায়ার, গান ব্যাটলের অদ্ভুত সব গল্প, অলীক গল্প তৈরি করে তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। সিগন্যালে থামে গাড়ি, হকার ছেলেপেলে, ইয়াং ছেলেপেলে সব আসে। দেখে বলে যে স্যার, আমি বিএনপি করতাম লক্ষ্মীপুরে। এত মামলা, পালিয়ে চলে এসেছি। এখন হকারি করছি। রিকশা চালায় আমাদের ছেলেপেলে।’ এরপরেই গলা ধরে আসে মির্জা ফখরুলের। একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, ‘এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা আছি। গুম করে দেয়, খুঁজে পাওয়া যায় না। বাচ্চাগুলো এখানে দাঁড়িয়ে বলল আপনাদের সামনেই।’
মাত্র গত সপ্তাহে গদ্যকার্টুন কলামে হাতির শোকে সরিষাবাড়ীর চরাঞ্চলের মানুষের কান্নার প্রসঙ্গে লিখেছিলাম, ‘মানুষ কাঁদুক। ঝরা পালকের বেদনায় বেদনার্ত হোক, একটা হরিণের মৃত্যুতে কাঁদুক, শালিকের মৃত্যুতে কাঁদুক এবং মানুষের সুখে-দুখে সে চোখের জল ফেলুক। মানুষের জীবন যেন তার কাছে সবকিছুর চেয়েই বেশি মূল্যবান বলে মনে হয়!’
মির্জা ফখরুল রাজনীতিতে সজ্জন হিসেবেই গণ্য। শিক্ষক মানুষ, বামধারার রাজনীতি করতেন। তাঁর কথাবার্তা, বেশভূষা, চালচলনে একটা মার্জিত ভাব আছে। তাঁর কান্নাটা যে মেকি নয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুই বছর আগে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে ব্রাজিলের অধিনায়ক থিয়েগো সিলভা খেলা শুরুর আগে জাতীয় সংগীত বাজার সময় কেঁদেছিলেন। তারপর তাঁর দল যখন জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নিল, তখন এই সমালোচনাও হয়েছিল যে, যে অধিনায়ক খেলা শুরুর আগেই কাঁদেন, তাঁর দলের ছেলেরা কীভাবে খেলায় জিতবেন।
মির্জা ফখরুলের এই কান্নাও কি সেই রকমের বার্তা দেয় যে বিএনপির আর কোনো আশা নেই?
মাহবুব উল আলম হানিফ ২৪ আগস্ট বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া, আপনি ডুবন্ত মানুষের মতো খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ভাসার যে চেষ্টা করছেন, এই রামপাল ইস্যু নিয়ে আপনার ভাসার কোনো সুযোগ নেই। আপনার রাজনীতি বহু আগেই ডুবে গেছে। আপনি নিজেই তা ডুবিয়ে দিয়েছেন।’
বিএনপির রাজনীতি কি আসলেই ডুবে গেছে?
মির্জা ফখরুলের কান্নার সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা কতখানি কাজ করেছে, আর বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে দুর্ভাবনা কতটা কাজ করেছে, আমরা তা নিয়ে গবেষণা করতে পারি, কিন্তু মানুষের মনের আসল খবর তো আর আমরা বলতে পারব না। মির্জা ফখরুলের কি এই কথাও মনে হয়েছে যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের একাংশের জড়িত থাকার অভিযোগটাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমঝোতা, ঐকমত্য, পরমতসহিষ্ণুতা, ভিন্নমতের সহাবস্থানের পরিসরটিকে চিরদিনের জন্য অপসারিত করে দিয়েছে? এ জন্য বিএনপি জোট সরকারের ২১ আগস্টের ভূমিকাকেই প্রধানত দায়ী করা যায়? আমি যদি বিশ্বাস করি, ‘ক’ আমাকে হত্যা করার জন্য গ্রেনেড মারার আয়োজন করতে পারে, এরপর ‘ক’-এর সঙ্গে আমি সমঝোতা করতে যাব কেন? আমার লক্ষ্য হবে, যেকোনো প্রকারে ‘ক’-কে নিবৃত্ত করা, পারলে নির্মূল করা।
এর আগে অনেক বিশ্লেষক, কলাম লেখক, টক শোর আলোচক বারবার বলেছেন, বাংলাদেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এই দুই দলকে বড় বড় জাতীয় প্রশ্নে ঐকমত্যে আসতে হবে, পরস্পরের জনপ্রিয়তা ও ঐতিহাসিক ভূমিকাকে মেনে নিতে হবে, সম্মান করতে হবে এবং দুই ধারার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ২১ আগস্টের পর সেই কথা বলার মতো পরিস্থিতি আর নেই। এ কথা বলার মতো লোকও হয়তো নেই। বললেও সে কথায় পাত্তা দেওয়ার মতো বাস্তবতা নেই।
এ কথা সবাই জানেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচনের আগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করেছিলেন তখনকার বিরোধী নেত্রীকে, সেই আলোচনা মধুর হয়নি, কোনো ফলও দেয়নি। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যুর পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বাসভবনে। কেউ দরজা খুলে দেওয়ার সৌজন্যটুকু দেখানোর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপি ও তার জোট। সংসদে এখন আওয়ামী লীগ ও তার জোট, বিরোধী দলের ভূমিকায় জাতীয় পার্টি, সেটা অনুগত বিরোধী দলই, কারণ তারা নির্বাচন করেছে একই প্ল্যাটফর্মে থেকে। বিএনপির মহাসচিব কাঁদছেন। আওয়ামী লীগ ও তার জোট ক্ষমতা সংহত করেছে। দেশেও তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইআরআই-এর সর্বশেষ জরিপে তাই দেখা গেছে। দাতারা সরকারকে সহযোগিতা করছে, যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে খুবই আগ্রহী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির আসন্ন সফরও সেই লক্ষ্যে বলে খবরে প্রকাশ। তাহলে দেশে কি কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল থাকবে না? সেটা কি দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এমনকি সরকারের জন্য ভালো হবে?
এইখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে উদ্ধৃত করি। বঙ্গবন্ধু ৫০-এর দশকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি।’ ‘বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না’, এটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। ক্ষমতা মানুষকে নিঃসঙ্গ করে। ক্ষমতার একটা প্রবণতা হলো নিপীড়নমূলক হওয়া। এটা সারা পৃথিবীতে সাধারণভাবেই সত্য। বলা হয়ে থাকে, পাওয়ার করাপ্টস অ্যান্ড অ্যাবসোলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলুটলি। কাজেই ক্ষমতাকে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। সেটা করবে বিরোধী দল, সেটা করবে শক্তিশালী গণমাধ্যম, সেটা করবে নাগরিক সমাজ। এবং আইনের ব্যত্যয় হলে সরকারকে ঠিক পথে রাখতে প্রয়াস পাবে স্বাধীন বিচার বিভাগ।
আমাদের দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামশীল সংবাদকর্মীরা স্বাধীনতার চর্চা করতেও সচেষ্ট। তবু যেন পরিসর ছোট হয়ে আসছে। হাত-পা ছুড়ে সাঁতার কাটার ও শ্বাস নেওয়ার জায়গা কমে আসছে। সেটা কারও জন্যই সুসংবাদ নয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, অন্ধ ও স্বার্থপর স্তাবকেরা তার বন্ধু নয়। সমালোচকই শ্রেষ্ঠ বন্ধু। কেউ যখন ভুল করে, তখন সত্যিকারের বন্ধু ভুলটি ধরিয়ে দেয়। স্বার্থান্ধ স্তাবকেরা তখনো স্তাবকতা চালিয়ে যায়। একটা ভুল আরেকটা ভুল ডেকে আনে। সরকারের নিজের স্বার্থেই সমালোচনার পরিসর উন্মুক্ত আর বাধাহীন করা উচিত। কার্যকর বিরোধী দল যখন নেই, তখন বাক্স্বাধীনতা, প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার ও বিক্ষোভ করার স্বাধীনতা সরকারেরই নিশ্চিত করা উচিত। এই সময়ে নাগরিক সমাজেরও সোচ্চার থাকা বেশি করে দরকার। দুঃখের বিষয়, আমাদের নাগরিক সমাজও দুটি ধারায় বিভক্ত। স্বাধীন অবস্থান নেওয়ার লোক ও সাহস সমাজে কমে গেছে।
এর মধ্যে যে রামপাল প্রশ্নে সুলতানা কামাল কিংবা আনু মুহাম্মদরা কথা বলছেন, সেটাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। কোন পক্ষের কথা বেশি যৌক্তিক, সেটা বোঝা যাবে মুক্তভাবে কথা শোনা গেলে। কাজেই কথা বলতে দিতে হবে, কথা শুনতে হবে। আর নাগরিক সমাজ যদি কোনো বিষয়ে আপত্তি তোলে, যদি একজন নাগরিকও কোনো জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে কোনো একটা আপত্তি তোলেন, সেটাকে আমলে নেওয়াই গণতান্ত্রিক রীতি। তবে আমরা যে কোনো আন্দোলনে একটাই আওয়াজ তুলি, জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো। অঞ্জন দত্তের একটা গান আছে, সুদিন আসবে বলে ওরা আগুন জ্বালায়, আর হাজার হাজার মানুষ মরে যায়। ভাবছি, সুন্দর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে আমলে নেওয়ার সংস্কৃতি কবে এই দেশে চালু হবে! যেমনটা হয়েছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের সময়। একজন লোক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যদি একা প্রতিবাদ করেন, তা যদি ন্যায্য হয়, কর্তৃপক্ষ তা গ্রাহ্য করবে, সেই রকম দিন কি এই দেশে আসবে না?
মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সাদাপোশাকে ধরে নিয়ে যাওয়া, গুম-ক্রসফায়ার ইত্যাদি বন্ধ করে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই বলেই সেটা আরও বেশি প্রয়োজন। আর সেই কথাটা বলা থেকে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে বিরত থাকলে চলবে না। সরকারকে মনে করিয়ে দিতে হবে এই আপ্তবাক্য ‘মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান) প্রথম আলো
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।