‘তুমি রিকশাওয়ালা হতে পারো না?’
থাকতাম পুরান ঢাকায়। পড়তাম পোগোজ স্কুলে। তখন সম্ভবত ক্লাস সিক্স কি এইটে পড়ি। এক দিন নোটিশ দেওয়া হলো, স্কুলের শতবর্ষ উদ্যাপন করা হবে। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকটি মঞ্চায়ন করা হবে। যারা অভিনয় করতে আগ্রহী, তাদের কমনরুমে দেখা করতে বলা হলো। আমি তখনো অভিনেতা নই; বরং সারা দিন ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন—এসব খেলে দিন কাটে। ক্লাসের ক্যাপ্টেন ছিলাম বলে আমার বেশ কিছু সঙ্গী-সাথি ছিল। ওরা আমাকে কমনরুমে নিয়ে গেল। আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য। বাংলা ও ইংরেজিতে ডাবল এমএ। খুব নমস্য ব্যক্তি। তিনি কমনরুমে ঢুকেই বললেন, ‘তুই এখানে কেন?’ আমি বললাম, ‘নাটক করব।’ ‘আগে করেছিস?’ ‘না।’ ‘আমি তো নোটিশ দিয়েছি, যারা নাটক করবে, তারা আসবে।’ নাটকটির যিনি নির্দেশনা দেবেন, তিনি বললেন, ‘স্যার, প্রহরী চরিত্রে লোক লাগবে। ওকে দিয়ে করানো যায়।’ স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা। তোকে প্রহরীর চরিত্রটি করতে হবে। তবে আমি কোনো নালিশ শুনতে চাই না।’ তারপর মহড়া শুরু হলো। সেখানে সংলাপ বলতে গিয়ে আমার কেন যেন খুব মজা লাগল! এভাবেই অভিনয়ের প্রতি টান জন্মাল। একবার মহড়ায় দেখা গেল, ঠাকুর দা চরিত্রের অভিনেতা আসেনি। আমি বললাম, ‘স্যার আমি করব।’ এভাবে অমল, এমনকি নারীচরিত্র সুধা—এক এক করে নাটকের সব চরিত্রের প্রক্সি দিলাম। এভাবেই আসলে অভিনয় শুরু।
সিনেমায় কিভাবে এলেন?
‘ডাকঘর’ নাটকটি করার পর, সহপাঠী বন্ধুরা অভিনয়ের ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিল। আমাকে ধরে নিয়ে গেল লালকুঠিতে (নর্থব্রুক হলে)। তখন সেটিই ছিল ঢাকার সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রস্থল। ওখানে বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের মহড়া হতো। বাবু ননী দাশ, এজাজ খান, অরুণ বোস, এইচ আকবর—এঁরা ছিলেন নাটকের একেকজন ওস্তাদ। তাঁরা আমাকে খুব আদর-আপ্যায়ন করলেন। তাঁদের কাছ থেকে শিখে নিলাম—কিভাবে নাটক করতে হয়, নাটকে কিভাবে হাঁটাচলা করতে হয়। তাঁদের মধ্যে এইচ আকবর আমার সরাসরি গুরু। তাঁর নির্দেশনায় নাটক করলাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি ছবি করছি। শুটিং দেখতে আসেন একদিন।’ শুটিং চলছিল পুলিশ হাসপাতালে। আমি গেলাম। বসে আছি। হঠাৎ এইচ আকবর শুটিং থামিয়ে আমার সামনে পায়চারি শুরু করলেন। তারপর বললেন, ‘ডাক্তার চরিত্রের অভিনেতা আসেননি। আপনিই করে দিন।’ এভাবে একেবারেই আচমকা চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু আমার।
কেমন ছিল ক্যামেরার সামনে প্রথম অভিজ্ঞতা?
ডাক্তার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মুহূর্তেই কস্টিউম ও অন্য জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। কেউ শার্ট এনে দিল, কেউ জুতা। ক্যামেরাম্যান মাসুদ টাই লাগিয়ে দিলেন। অ্যাপ্রোন হাতে আমি ঢুকে গেলাম শুটিংয়ে। চলচ্চিত্রটির নাম ‘জলছবি’ (১৯৭১)। মুক্তিযুদ্ধের আগেই মুক্তি পেয়েছিল। এটি চলচ্চিত্রকার হিসেবে এইচ আকবর, চিত্রনাট্যকার হিসেবে এ টি এম শামসুজ্জামান, নায়ক হিসেবে ফারুকের প্রথম চলচ্চিত্র। নায়িকা ছিলেন কবরী। আনোয়ার হোসেন ও রোজী আফসারীর মতো বড় শিল্পীরাও অভিনয় করেছেন। আমি ডাক্তারের ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করলেও ক্রেডিট লাইনে আমার নামটি পর্দাজুড়ে ‘প্রবীর কুমার মিত্র’ লিখে সম্মান জানিয়েছিলেন পরিচালক। দেখে নিজের কাছেই মনে হলো, নামটি বেশ বড়! তাই এরপর নিজের নাম থেকে ‘কুমার’ শব্দটি ছেঁটে নিয়েছি।
এরপর চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন?
মাঝখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিরতি শেষে ১৯৭৩ সালে আমার পরবর্তী চলচ্চিত্র ‘জীবনতৃষ্ণা’ মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রে আমি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছি। চরিত্রটি ছিল অন্ধের। আমি ছিলাম সুচন্দার ভাই। আমার আর তাঁর লিপসিংয়ে ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে…’ গানটি সবার মুখে মুখে ঘুরেছে। এরপর আমি পরিচিত হয়ে ওঠি। একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকি। এ সময়ের একটি ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে আছে। এক দিন এফডিসির দুই কি তিন নম্বর ফ্লোরে কোনো একটি চলচ্চিত্রের শুটিং করছিলাম। এক প্রডাকশন বয় এসে বললেন, ‘আপনার জন্য বাইরে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি ভেতরে আসবেন না।’ আমি ফ্লোর থেকে বের হয়ে দেখি, বোরকা পরা এক বয়স্ক মহিলা। তিনি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাবা, আমি তোমার অভিনয় দেখেছি। ওই গানটা দেখেই বুঝেছি, তুমি একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।’ মন খুলে আশীর্বাদ করে গেলেন তিনি। অনেক পরে জেনেছি, তিনি সুচন্দার নানি। এ চলচ্চিত্র নিয়ে একটি মজার স্মৃতিও আছে। শুটিংয়ের শুরুর দিকে সুচন্দা আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কলকাতা থেকে কবে এসেছেন?’ আমি বললাম, ‘কেন?’ ‘আপনি কলকাতার শিল্পী না?’ আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। পরিচালক এইচ আকবরকে ডেকে বললাম, ‘ওস্তাদ, দেখেন কী কয়!’ সুচন্দা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। পরিচালক বললেন, ‘আরে না, ও তো ঢাকার ছেলে!’ সম্ভবত নাম ও চেহারার কারণে শুরুতে অনেকেই ভাবত, আমি কলকাতার মানুষ।
ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ আপনাকে আলাদাভাবে মহিমান্বিত করেছে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় কিভাবে?
তত দিন মাত্র দু-তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। রাজ্জাকের সঙ্গে কোনো একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করছিলাম। দুজন মেকআপ নিচ্ছি। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম, ঋত্বিক ঘটক ঢাকায় এসেছেন। তিনি হিরো খুঁজে পাচ্ছেন না। বাংলাদেশের বড় বড় আর্টিস্ট দেখেছেন, কাউকেই তাঁর পছন্দ হয়নি। এরপর এক দুপুরবেলা বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ কমেডিয়ান ফরিদ আলী, সানওয়ার মুর্শেদ ও আরো কয়েকজন এসে হাজির হলেন। বললেন, ‘চলুন, ঋত্বিক দা আপনাকে দেখবেন।’ ঋত্বিক তখন উঠেছিলেন লালমাটিয়ার একটি বাসায়। লালমাটিয়ায় তখন খানাখন্দ, লাল সুরকি, লাল মেঝে। গিয়ে দেখি, তিনি ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। টেবিলে একটি বিশেষ বোতল। তিনি সিগারেট টানছেন আর উপন্যাস পড়ছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘আপনি স্যান্ডেল খোলেন। এইটা একটা মাজার, মিয়া! স্যান্ডেল খোলেন!’ কেউ একজন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘এই হলো প্রবীর।’ ঋত্বিক আমাকে বসার জন্য ইশারা করলেন। আমি বসলাম। বসে আছি। তিনি সিগারেট টানছেন। পানীয় পান করছেন। আর মাঝে মাঝে আমাকে দেখছেন। সেই দৃষ্টি এতই প্রখর, আমি সহ্য করতে পারছিলাম না! আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে হঠাৎ গর্জে উঠলেন, ‘স্ট্যান্ডআপ!’ দরজার দিকে মুখ করে দাঁড় করালেন আমাকে, যেখান থেকে আলো আসে। গোধূলিলগ্নের সেই আলো এসে আমার মুখে পড়ল। আসলে তিনি স্ক্রিন টেস্ট নিচ্ছেন। তাঁর চোখই ক্যামেরা। বললেন, ‘মুভ!’ আমি ফাস্ট মুভ করলাম। তারপর বললেন, ‘হোল্ড!’ এভাবে কয়েকবার মুভ-হোল্ড করিয়ে, তারপর বললেন, ‘সিট ডাউন’। এরপর আমি বের হয়ে এলাম। পরে জানলাম, আমাকে নির্বাচন করেছেন তিনি।
তাঁর সঙ্গে কাজ করার প্রস্তুতি কেমন ছিল?
‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ আমার চরিত্রটি জেলের; কিন্তু তখন আরো দু-তিনটি ছবির কনটিনিউটি হিসেবে আমার গোঁফ ছিল, বড় জুলফি ছিল। এই চরিত্রে কাজ করতে গেলে তো গোঁফ থাকবে না, জুলফিও এত বড় রাখা যাবে না। সমস্যায় পড়ে গেলাম। ছুটলাম আমার ওস্তাদ এইচ আকবরের কাছে। ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে সুযোগ পেয়েছি, এ খবরে ওস্তাদ মহাখুশি! বললেন, ‘গোঁফটোফ সব ফালায়া দেব, চিন্তা করবেন না!’ তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর ওস্তাদ মোহাম্মদ ইয়াসিনের কাছে। তারপর দুজন মিলে নিয়ে গেলেন এফডিসিতে। রহমান (বড় রহমান) তখন ছিলেন মেকআপম্যান। এফডিসির ২ নম্বর ফ্লোরে, তাঁর কাছে গিয়ে বসলাম। তিনি শিঙাড়া খাওয়ালেন। আর বললেন, ‘এখন ফেলে দিই। কনটিনিউটির জন্য আবার গোঁফ-জুলফি বানিয়ে দেব!’ তিনি যদি তখন সাহায্য না করতেন, তাহলে হয়তো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ অভিনয় করার সুযোগটি থাকত না আমার। এই যে রহমান, এই যে এফডিসির এত মানুষ আমাকে এতটা ভালোবাসতেন, তাঁদের কথা মনে পড়লে এখন কান্না পায়।
ঋত্বিকের সঙ্গে কাজের দিনগুলো কেমন ছিল?
মনে পড়ে, শুটিংয়ের প্রথম দিন পায়চারি করছিলাম। মোড়ল গিন্নি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কলকাতা থেকে এসেছিলেন বনানী চৌধুরী। আমি নতুন—এ কথা জেনে তিনি বললেন, ‘ওই লোকটা (ঋত্বিক ঘটক) আপনাকে মারবেন, গালাগালি করবেন, থুথু দেবেন—তবু সাবধান, আপনি একটা কথাও বলবেন না। তিনি যা করতে বলবেন, আপনি তাই করবেন। উনি আমাকে শুধু বলেছেন, বনানী চলে আয়। আজ আমার শুটিং নেই। আজকেই আবার আমাকে কলকাতা ফিরে যেতে হবে। তবু আমি চলে এসেছি।’ তাঁর এই পরামর্শ আমি শিরোধার্য হিসেবে মেনে নিলাম। এক দিন আরিচার এক ডাকবাংলোতে শুটিং চলছিল। সব আর্টিস্ট রেডি হয়ে ঋত্বিকের সঙ্গে যাচ্ছেন। সেদিন আমার শুটিং ছিল না বলে বসে আছি। হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে তিনি আমাকে ডাকলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই বসে আছিস কেন?’ বললাম, ‘আমার তো শুটিং নাই।’ উনি বললেন, ‘ইডিয়ট! শুটিং নাই তো কী হয়েছে? শুটিং দেখতে হয়। রেডি হয়ে আয়।’ এই যে শুটিং শুধু করলেই হয় না, দেখতেও হয়—এটি আমার জন্য অনেক বড় একটি শিক্ষা। তারপর এক দিন দোল উৎসবের একটি দৃশ্যের শুটিং চলছে। আমি (কিশোর চরিত্রটি) তখন পাগল। গোসল করতে চাই না। মা আমাকে নদীতে নিয়ে গেছে। গিয়ে দেখি, নদীর পারে কবরী (রাজার ঝি চরিত্রটি)। হাতে রাখা আবীর। তার মধ্যে ধান। দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। একটা সময় তাকে পাঁজাকোলে নিয়ে আমি দৌড় দিলাম। ক্যামেরাম্যান ছিলেন বেবী ইসলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি তো ভুল কোনা দিয়ে ফ্রেম-আউট হয়েছ। শটটি আবার নিতে হবে।’ এ কথা শুনে ঋত্বিক বললেন, ‘গ্রামারের আলাপ রাখো তো! শট ঠিকই আছে। আমি গ্রামার মানি না! আমার চোখে যেটা ভালো লাগবে, সেটাই গ্রামার।’ আরেক দিন ক্যামেরা ওপেন করে বেবী ইসলাম বললেন, ‘ক্যামেরার কোথায় যেন একটা শব্দ হচ্ছে। শুটিং করা সম্ভব নয়।’ ঋত্বিক বললেন, ‘চালা তো দেখি!’ এই বলে ক্যামেরায় চোখ রাখলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘ওই জায়গার স্ক্রুটা লুজ হয়ে গেছে। টাইট করে দে।’ বেবী ইসলাম ক্যমেরা খুলে সেই স্ক্রুটি টাইট করে দিলেন। তারপর শুটিং শেষে পরীক্ষা করার জন্য ফিল্ম পাঠানো হলো এফডিসিতে। দেখা গেল, ফুটেজ সবই ঠিকঠাক আছে। আরেকবার ফিল্ম ওয়াশ করার সময় ল্যাব ইনচার্জ ইউসুফ আলি খান খোকাকে তিনি কী যেন এক কেমিক্যালের নাম নিয়ে বললেন, মিক্সচারে সেটির পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে। তারপর বললেন, ‘মিটারটা নিয়ে আয় তো।’ মিটার এনে দেখা গেল, তাঁর অনুমান ঠিকই ছিল। অন্যদিকে, চলচ্চিত্রটির মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান। এক দিন তিনি মিউজিক করছেন, আর ঋত্বিক ঘটক আচমকাই ‘বাহাদুর…’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। বাহাদুর খান সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘স্যরি, দাদা স্যরি!’ বুঝতে পারলেন, ভুল বাজিয়েছেন। ভাবুন তো, কত বড় শিল্পী হলে একজন মানুষের নখদর্পে এত কিছু থাকতে পারে? এমন মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারা আমার সৌভাগ্য। এটি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে।
আপনার অভিনয় নিয়ে ঋত্বিকের মূল্যায়ন কী ছিল?
তিনি সরাসরি কিছু বলেননি। তবে কবরী বলেছেন, ‘প্রবীর, আপনি খুব ভালো করছেন।’ কবরীর অবশ্য তখন একটা নাক সিঁটকানো ভাব ছিল! কাউকেই তাঁর পছন্দ হতো না। এক দিন শুটিং ক্যাম্পের পাশ দিয়ে আমি যাওয়ার সময় কবরী ‘এই খ্যাত, এই খ্যাত…’ বলে চিৎকার করে ডাকছিলেন। আমি শুনেও না শোনার ভান করে চলে গিয়েছি। তখন সেখানে বসে থাকা রোজী আফসারী, রওশন জামিল, রানী সরকার—এঁরা কবরীকে নিবারণ করেছেন। বুঝতে পারছি, কবরী তখন দুষ্টুমি করছিলেন; তবে সে সময় মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল আমার।
আপনাকে প্রচলিত হিরো হিসেবে নয়, বরং ক্যারেক্টার আর্টিস্ট হিসেবেই অভিনয় করতে দেখা যায়…
৩০০-এর মতো চলচ্চিত্রে আমি অভিনয় করেছি। হিরো হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না, বরং ক্যারেক্টার খুঁজেছি। মনে মনে ভেবেছি, কিসের হিরো? সব উড়িয়ে দেব! আমার সামনে সব উড়ে যেত! এই সচেতনতাবোধ নিজের মধ্যে ছিল। পরিচালকরাও আমাকে দিয়ে শক্তিশালী চরিত্রগুলোতে অভিনয় করিয়েছেন। অভিনয়ই আমার ধ্যানজ্ঞান। অভিনয় খুব মজার জিনিস। মজা হলো, আমি ব্যক্তিজীবনে যা নই, সেটাই সাজছি। আমি রিকশাওয়ালা না, কিন্তু রিকশাওয়ালার ক্যারেক্টার করছি। এ ব্যাপারটি আমার মজা লাগত। একজন রিকশাওয়ালা কিভাবে পেডাল চাপেন, রিকশা ছেড়ে দেওয়ার পর কিভাবে হাঁটেন, কথা বলেন—সব মিলিয়ে তাঁকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারায় একটা মজা আছে। কিংবা ঠেলাগাড়িওয়ালার চরিত্রে অভিনয়ের সময়, বাস্তবের ঠেলাগাড়িওয়ালার শারীরিক গড়ন কেমন, কী ভঙ্গিমায় তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নেন—নিজের মধ্যে এসবের রূপান্তর ঘটাতাম। তথাকথিত হিরোর একঘেয়েমিতার চেয়ে, অভিনয়ের ভেতর দিয়ে নানা রকম মানুষের জীবনকে উপভোগ করতে পারা ছিল আমার জন্য আনন্দ।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের উত্থান ও পতন—দুই-ই আপনার দেখা। পতনের কারণ কী বলে মনে করেন?
যখন কাজ শুরু করেছিলাম, তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের ধরন ও পরিবেশ ছিল অন্য রকম। আমার ওস্তাদের কথাই যদি ধরি, এইচ আকবর একটি চিত্রনাট্য নিয়ে মাসের পর মাস কাজ করতেন। এখন দেখি, সব কিছুতেই কেমন তাড়াহুড়া! অন্যদিকে, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, খলিল উল্লাহ খান, গোলাম মোস্তফা—এ রকম কত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন তখন। তাঁরা আমাকে দেখিয়ে দিতেন, ‘এটা এভাবে করো, ওভাবে করো…।’ তাঁদের বিশ্বাস ছিল, তাঁরা বললে আমি শুনব। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল তখন। ধীরে ধীরে সব কিছু কেমন যেন বাণিজ্যিক হয়ে গেল। ছবি করতে হবে টাকার জন্য—এই মন্ত্রেই যেন দীক্ষিত হতে থাকলেন অভিনেতা, টেকনিশিয়ান, ফিল্ম ডিরেক্টর—সবাই। ছবিটা কী হবে—এ নিয়ে যেন কারো মাথাব্যথা নেই। সবার এ রকম টাকার পেছনে ছুটতে থাকার মাধ্যমেই আমাদের চলচ্চিত্রের অবক্ষয় শুরু হলো।
এফডিসিতে নিশ্চয়ই যান এখনো?
খুব একটা যাই না। এফডিসিতে গেলে আমার কান্না পায়। যাঁদের সঙ্গে কাজ করে দীর্ঘদিন কাটিয়েছি, তাঁদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। পরিবেশটাও কেমন যেন মনমরা। মনে পড়ে, তখন কনটিনিউটি ঠিক রাখার জন্য মেকআপম্যানদের কাছে অভিনেতাদের পোস্টকার্ড সাইজ ছবি দেওয়া থাকত। শুরুর দিকে এক দিন জুনিয়র রহমানের কাছে মেকআপ নিতে নিতে আমার এমনই একটি ছবির উল্টোদিকে কিছু একটা লিখে রেখেছিলেন খলিল উল্লাহ খান। বলেছিলেন, ‘রহমান, এই লেখাটা এক বছর পর পড়বা। এর আগে তুমি নিজেও দেখবা না, কাউকেও দেখাবা না।’ পরে রহমানের কাছে শুনেছি, খলিল ভাই আসলে লিখেছিলেন, ‘এই ছেলেটি একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।’ এই যে পর্যবেক্ষণ, এই যে ভালোবাসা—সেসব এখন কোথায় হারিয়ে গেছে! তবু কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। চলচ্চিত্রে এসেছিলাম বলেই এখনো কোটি কোটি মানুষ আমাকে চেনে।
আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
১৮ আগস্ট ১৯৪১, সোমবার, মামাবাড়ি চাঁদপুরের নতুন বাজারে আমার জন্ম। আমি মা-বাবার প্রথম সন্তান। খুব আদর-যত্নে মানুষ হয়েছি। ছোট ভাই সুবীর মিত্র থাকে ঢাকায়। আর ছোট বোন সরস্বতী বসু কলকাতায় ও রমা সরকার দিল্লিতে থাকে। আমার ছোটবেলা কেটেছে ১৭ নম্বর হরিপ্রসন্ন মিত্র রোডে। এই সড়কটির নামকরণ আমার দাদার নামে। শৈশবে সারা দিন খেলতাম আর ঘুরতাম। সেই বন্ধু ও সঙ্গী-সাথিদের সবাই অনেক আগেই কলকাতায় চলে গেছে। ১৯৬২ সালে এসএসসি পাস করার পর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই আমি। সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৬ সালে পরিসংখ্যানে বিএসসি পাস করেছি। আমার পেশা ও নেশা—সবই অভিনয় ঘিরে। কোনো দিন চাকরি করিনি; চাকরির চেষ্টাও করিনি। আমি বিয়ে করেছি ১৯৭৩ সালে। স্ত্রী অজন্তা মিত্র এখন আর বেঁচে নেই। আমাদের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে পরিবারে খুব একটা সময় দিতে পারতাম না। প্রতিদিন রাত করে বাসায় ফিরতাম। এক দিন রাতের বেলা আমাকে খাবার দিয়ে স্ত্রী হঠাৎ বলে উঠল, ‘তুমি রিকশাওয়ালা হতে পারো না?’ আমি বললাম, ‘মানে?’ সে বলল, ‘তুমি সকালবেলা রিকশা নিবা। দুপুরে জমা দিবা। তারপর চলে আসবা। কিংবা তুমি ২টার সময় রিকশা নিবা। সন্ধ্যার সময় জমা দিয়ে বাসায় এসে পড়বা। যে কাজ করো, তোমার তো কোনো টাইমটেবল নাই।’ এটি তাঁর আক্ষেপ ছিল। তবে আমাকে সে অভিনয় করা থেকে সরাতে পারেনি; হয়তো চায়ওনি।
সূত্র: কালের কন্ঠ