জনসংখ্যাই শক্তি
নিউজ ডেস্ক : এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ডে ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। এ সংখ্যা বাড়ছে। তবে সরকারের নানামুখি পরিকল্পনায় জনসংখ্যা পরিণত হচ্ছে সম্পদে। মানুষের সচেতনতা বেড়েছে, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। এক সময়ের বোঝা বলে বিবেচিত বিপুল জনসংখ্যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় পরিণত হচ্ছে সম্পদে।
উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে দেশ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয় থেকে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ জায়গা করে নেবে উন্নত দেশের তালিকায়।
আগামী দিনের সম্পদ : সঠিক শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করে তৈরি করা গেলে জনগণই আগামী দিনের সম্পদে পরিণত হবে।
কেননা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একমাত্র দক্ষ জনশক্তির দ্বারাই সম্ভব। দেশের জনসংখ্যা বোঝা নয়, এটি সম্পদ। জনসংখ্যা বিশারদদের ভাষায় বাংলাদেশের জন্য এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা থেকে ‘লভ্যাংশ’ পাওয়ার সময়।
দরকার উপযুক্ত কর্মসংস্থান: বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ স্থবির।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। তারা চাকরি পাচ্ছে না। বাংলাদেশে জনসংখ্যার স্থানান্তর ও নগরায়ণ পরিকল্পিত নয়। কর্মসংস্থান না থাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ রাজধানীর দিকে ছুটছে। এ জন্য ঢাকায় দারিদ্র্যের হার বাড়ছে।
জনশক্তি রপ্তানিতে গত ৪১ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, এ বছর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবেই গেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ কর্মী। এর পরই আছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার ও ওমান।
হিসাব বলছে, পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মী বিদেশে যাওয়ার দিক থেকেও সৌদি শ্রমবাজার এগিয়ে আছে। ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে এক লাখ ১৯ হাজার ৬৯৭ নারী কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরবেই গেছে ৮১ হাজার ৫১৩ জন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, এবার সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে মালয়েশিয়ায়; ৯৬ হাজার ৪৭৭ জন। এরপরে আছে যথাক্রমে ওমান (৮৭ হাজার ৬৬১), কাতার (৮০ হাজার ৭৯৭), সিঙ্গাপুর (৩৯ হাজার ৬৯০), জর্ডান (২০ হাজার ২১৫) এবং বাহরাইন (১৯ হাজার ২৭৩)।
১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। ওই বছর গিয়েছিল ছয় হাজার ৮৭ জন। ৪১ বছরের মধ্যে এবারের আগের রেকর্ড ছিল ২০০৮ সালে। ওইবছর জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল আট লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ জন।
চাই মহাপরিকল্পনা : বর্তমানে আমাদের দেশের অন্যতম বড় সমস্যা শিক্ষিত বেকারত্ব। প্রকৃতপক্ষে দেশে ১৮ হইতে ২৯ বত্সরের তরুণ-তরুণীদের মাঝে শিক্ষিতের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তাহাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই এই সময়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এইজন্য এমনভাবে অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। আবার দক্ষ জনবলের অভাব দূর করিতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতেও নজর দেওয়া আবশ্যক।
এর মাধ্যমে মানসম্মত চাকরি এবং মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই একেকটি মানুষ পরিণত হবে একেকটি সম্পদে।
শিক্ষা দিয়েছে সচেতনতা : দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস বা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারের সন্তান সংখ্যা নিরক্ষর পরিবারের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কম। উন্নয়নেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের অবদান অনেক বেশি। অদক্ষ জনগণ একটি দেশের বোঝা। পক্ষান্তরে দক্ষ জনগণ দেশের সম্পদ, যা মানবসম্পদ নামে পরিচিত। পরিকল্পিত উপায়ে জনগণকে মানবসম্পদে রূপান্তর করা গেলে অপ্রতিরোধ্য গতিতে দেশ এগিয়ে যাবে। জনগণকে জনসম্পদে রূপান্তরের প্রধান উপায় শিক্ষা।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর আলোকে শিক্ষার মাধ্যমে দেশের জনগণকে মানবসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব ধারণা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন কাজ করার দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১৩ সালে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’ এবং নবম-দশম শ্রেণীতে ‘ক্যারিয়ার শিক্ষা’ চালু করা হয়েছে।
রয়েছে কিছু অভিযোগও: বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সরকার তা নিচ্ছে না। কেবল দেশেই নয়, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে দক্ষতা তৈরির সরকারি উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। জনশক্তি রপ্তানিতে বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করলেও বিদেশের শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে তাদের ভূমিকাও গৌণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে কতগুলো বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবার আগে প্রয়োজন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। আর এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ছাড়া নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি সব ধরনের অসাম্য দূর করতে হবে। জনসংখ্যার বোনাস কালকে কাজে লাগাতে চাইলে সবার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত, বয়স্কদের জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী সম্প্রসারণ, মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য উপযোগী ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ১১ জুলাই। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী জানান, তার সরকার পরিকল্পিত পরিবার গঠনের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করে দারিদ্র্য বিমোচনসহ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। প্রতি ৬ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও প্রাইভেট চ্যানেলগুলো বিশেষ কর্মসূচি সম্প্রচার এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।
১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির গভর্নিং কাউন্সিল জনসংখ্যা ইস্যুতে গুরুত্ব প্রদান ও জরুরি মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সারাবাংলা