ফ্রি মোবাইল সিম ‘ফ্রি’ নয়
রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে তাকালেই চোখে পড়বে মোবাইল সিমের মেলা। বড় বড় ব্র্যান্ডের ছাতা মেলে ছোট টেবিল পেতে বায়োমেট্রিক ডিভাইস (আঙুলের ছাপ নেওয়ার যন্ত্র) নিয়ে আয়োজন সিম মেলার। মাইক বা সাউন্ড বক্সে ঘোষণা দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে মোবাইল ফোনের সিম। এসব মেলায় টাকা নেওয়া তো দূরের কথা, গ্রাহককে বিনাপয়সায় সিম দিচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটররা। শুধু তাই নয়, সিমের সঙ্গে উপহার দিচ্ছে ভয়েস কলের জন্য ফ্রি টকটাইম (কল মিনিট), কয়েক গিগাবাইট পর্যন্ত ফ্রি ডাটা তথা ইন্টারনেট (যা হালে এমবি নামেও পরিচিত)। এই যে এত এত ফ্রি-এর মেলা, এগুলো কি আদতেই ফ্রি?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ‘ফ্রি’ প্রকৃত অর্থে ‘ফ্রি’ নয়। আপাতদৃষ্টিতে ফ্রি মনে হলেও গ্রাহকের মোবাইল খরচ থেকেই তা আয় করবে অপারেটরগুলো। অনেকই বলছেন, এটা অপারেটরগুলোর গ্রাহক বাড়ানোর একটা কৌশল। এভাবে গ্রাহক বাড়ানো হলে হয়তো সব গ্রাহক সক্রিয় থাকবে না, তারপরও গ্রাহক যত বেশি বাড়ানো যায়।
অন্যদিকে, আরেক পক্ষ বলছেন, এত এত ফ্রি দিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটররা প্রমাণ করছেন, তারা চাইলে ভয়েস কল ও ইন্টারনেটের দাম আরও কম রাখতে পারেন। কারণ তারা ফ্রি দিলেও তো একদিন সেই সিম থেকেই মুনাফা করবেন। তারা মনে করেন, এভাবে ফ্রি না দিয়ে বরং দাম কমিয়ে দিলে গ্রাহকই আগ্রহী হবেন। গ্রাহক সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অপারেটরগুলোকে আর সিম ফ্রি বিক্রি করতে হবে না।
জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ উল্টো এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, ‘অপারেটররা সিম ফ্রি দিচ্ছে? এটা তো করার কথা নয়। টেলিটক সিম ফ্রি বিলি করছে বলে জানি (টেলিটক অপরাজিতা নামে ২০ লাখ সিম বিনামূল্যে গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করেছে, যদিও সেই অফার শেষ হয়ে গেছে)।’ অন্য অপারেটররাও গ্রাহকদের বিনামূল্যে সিম দিচ্ছে জানালে তিনি বলেন, ‘আচ্ছা, খোঁজ নিয়ে দেখব।’
সম্প্রতি রাজধানীর ভাষানটেক এলাকায় একটি সিম মেলা চোখে পড়ে। মেলা প্রাঙ্গণে কাগজে লেখা ছিল, ১০০ টাকা রিচার্জ করলে থাকছে দুইটি এয়ারটেল ও বাংলালিংকের একটি সিম ফ্রি। এর সঙ্গে উপহার হিসেবে থাকবে ২০০ টাকার ব্যালেন্স ও ৩০ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট। শুধু ভাষানটেক নয়, রাজধানীসহ সারাদেশেই এখন এই চিত্র দেখা যায়। বাংলালিংকের কোনও গ্রাহক যদি তার পুরনো সিম বদলে নতুন ফোরজি সিম সংগ্রহ করেন, তাহলে তিনি ৭ দিনের জন্য ৫ জিবি ইন্টারনেট ফ্রি পাবেন। সিম বদলে নিতে বাংলালিংক কোনও টাকা নিচ্ছে না।
জানা গেছে, একটি মোবাইল সিম কিনতে অপারেটরদের খরচ (উৎপাদনসহ অন্যান্য খরচ) হয় ১৭০-১৮০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১০০ টাকার সিম ট্যাক্স। আরও কিছু খরচও রয়েছে সিমের পেছনে। কোনও গ্রাহক টানা তিন মাস সিমটি ব্যবহার করলেই অপারেটরগুলোর পক্ষে সিমের পেছনে তাদের খরচ তুলে নিয়ে আসা সম্ভব। তবে গ্রাহকের কাছ থেকে মুনাফা করতে অপারেটরগুলোর ছয় থেকে ৯ মাস লেগে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবির বলেন, কোনও অপারেটর সিম ফ্রি দেবে না কি টাকার বিনিময়ে দেবে, এটা তাদের ব্যাপার। এটা তাদের ব্যবসায়িক কৌশল। এতে গ্রাহকেরই লাভ হচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একজন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর প্রতিমাসে মোবাইল ব্যবহারের গড় খরচের ওপর নির্ভর করে অপারেটরের খরচ তুলে নেওয়ার বিষয়টি। জানা গেছে, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর)একজন গ্রামীণফোন গ্রাহকের গড় খরচ (মোবাইল ব্যবহারের) ছিল প্রায় ১৬১ টাকা, রবি ও এয়ারটেলের ছিল ১২৫ টাকা এবং বাংলালিংকের ছিল ১১১ টাকা। তিন মাসের আগে কোনও ব্যবহারকারী সেই সিম ব্যবহার বন্ধ করলে সরাসরি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে বলে দাবি অপারেটরগুলোর।
জানতে চাইলে বাংলালিংকের চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, ‘আমরা ফ্রি সিম গ্রাহককে দিই, কিন্তু সেজন্য আমাদের ভর্তুকি দিতে হয়। সিম নিয়ে কোনও ব্যবহারকারী যদি তিন মাস ব্যবহার না করেন, তাহলে আমাদের ক্ষতি হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফ্রি দিয়ে তো বরং আমরা গ্রাহকেরই উপকার করছি।’
গ্রাহককে ফ্রি সিম দেওয়ার উদ্যোগটি বেশ কিছুদিন আগের। সম্প্রতি নারীদের মধ্যে বিনামূল্যে ২০ লাখ সিম বিতরণের অফার ঘোষণা করে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটক। ওই অফারে একসঙ্গে দু’টি সিম নিতে হতো। ওই সিমে এক জিবি ইন্টারনেট ৮ টাকা ও ২ জিবি ইন্টারনেট ১৪ টাকায় কেনার সুযোগ ছিল। তিন মাসের ওই অফার শেষ হলে গ্রাহকের ইন্টারনেটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অপারেটরটি। এখন গ্রাহককে ১ জিবি ইন্টারনেট কিনতে হয় ১৮ টাকা দিয়ে।
একজন টেলিকম বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, গ্রাহককে ফ্রি সিম দিয়ে এভাবেই মূল্য বাড়িয়ে দেয় অপারেটররা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিশেষজ্ঞ বলেন, টেলিটকের ৮ টাকায় এক জিবি ইন্টারনেটের দাম এখন ১৮ টাকা, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। সেই বর্ধিত দাম থেকেই সংশ্লিষ্ট অপারেটর ফ্রি সিমের খরচ বা ব্যয় তুলে নেবে।
জানতে চাইলে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘নারীরা আমাদের বিনামূল্যের সিমের (২০ লাখ) প্রায় ৬০ ভাগ সংগ্রহ করেছেন। এটা আমাদের জন্য একটি বড় সাফল্য।’
ইন্টারনেটের দাম বাড়ানোর বিষয়ে গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘তিন মাসের জন্য এক জিবির দাম ছিল ৮ টাকা (মেয়াদ ছিল ৭ দিন)। এখন তারা (নারীরা) তিন মাসের পরের প্যাকেজে চলে গেছেন।’
গ্রাহক বাড়ানো ও ফ্রি সিমের খরচ ওঠানোর জন্যই দাম বাড়ানোটা কৌশল হিসেবে নেওয়া হয়েছে কিনা— জানতে চাইলে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বিষয়টি সেরকম নয়। বিষয়টি এভাবে দেখা ঠিক হবে না।’