রবিবার, ৩রা জুন, ২০১৮ ইং ২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

কোটি টাকার জরিমানায় মান ডুবছে ফুটবলের

বিদেশি ফুটবল কোচ ও খেলোয়াড়দের ঠিকমতো বেতন না দেওয়া এবং ফিফা-এএফসির আইন ভঙ্গ করার দায়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ (বাফুফে) দেশের শীর্ষ চারটি ক্লাবকে গত দুই বছরের মধ্যে আর্থিক দণ্ড দিতে হয়েছে ১ কোটি টাকারও বেশি।

জাতীয় (পুরুষ) ফুটবল দলের যেমন নিম্নমান তাতে দেশের গৌরব এমনিতেই বাড়ছে না। বাফুফে বা ক্লাবগুলোর জরিমানায় দেশের মানসম্মান আরও ডুবছে। দেশের খেলোয়াড়, কোচ, সমর্থকদের আশঙ্কা—এমনটা চলতে থাকলে বিদেশি খেলোয়াড়-কোচদের কালো তালিকায় উঠে যেতে পারে বাংলাদেশের নাম। আবার ফিফার সর্বশেষ তালিকায়ও ২১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৭তম। এর চেয়ে খারাপ অবস্থানে দেশ আর কখনোই ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু শ্রীলঙ্কা (২০০) ও পাকিস্তান (২০১)।

বিষয়টিকে দেশের জন্য সম্মানহানিকর দেখছেন সাবেক তারকা খেলোয়াড় ও কোচ গোলাম সারোয়ার টিপু। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দেশের ফুটবল ফেডারেশন ও শীর্ষ ক্লাবগুলো জরিমানা দিচ্ছে, এতে অবশ্যই দেশের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ লাগছে যে ফুটবল ফেডারেশন আর্থিক দণ্ড দিচ্ছে। ক্লাবগুলো হয়তো বিষয়ের গুরুত্ব না বুঝে জরিমানা দিচ্ছে, কিন্তু ফেডারেশন কেন ফিফার কাছে খেলাপি হবে?’

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কাছে পাওনা টাকা চেয়ে ফিফায় অভিযোগ করেছিলেন ক্লাবটির সাবেক নাইজেরিয়ান কোচ এমেকা ইজিউগো। ফিফার নির্দেশ অনুযায়ী ওই টাকা পরিশোধে গড়িমসি করে অবনমন, এমনকি নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল মোহামেডান। সম্প্রতি এমেকাকে জরিমানাসহ পুরো অর্থ পরিশোধ তো করতে হয়েছেই, বাড়তি দণ্ড হিসেবে প্রিমিয়ার লিগ থেকে ৩টি পয়েন্টও কাটা যাবে ৮১ বছরের পুরোনো ক্লাবটির।

শুধু মোহামেডান ক্লাবই নয়, বাফুফেসহ আবাহনী, শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র মিলিয়ে ‘আক্কেলসেলামি’ দিয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ৩৫ হাজার ৩২২ টাকা। নতুন আরেকটি অভিযোগে শেখ রাসেলকে আরও ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৬ টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে ফিফা।

কাঠগড়ায় মোহামেডান
২০১২ সালে মোহামেডান কোচ করে আনে ক্লাবটির সাবেক নাইজেরিয়ান খেলোয়াড় এমেকা ইজিউগোকে। কিন্তু এক মৌসুম না পেরোতেই ক্লাব ছেড়ে যান এমেকা। ২০১৫ সালে তিনি মোহামেডানের কাছে ২০ হাজার মার্কিন ডলার পাওনা চেয়ে ফিফার কাছে নালিশ করেন। ওই বছরেরই ১৯ নভেম্বর ফিফা মোহামেডানকে ২০ হাজার ডলারের সঙ্গে মামলার প্রক্রিয়াগত মাশুল হিসেবে আরও ৩ হাজার সুইস ফ্রাঁ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। গত ৩০ অক্টোবর ফিফা মোহামেডানকে ওই অর্থ আদায়ের সঙ্গে প্রিমিয়ার লিগ থেকে তাদের ৩টি পয়েন্ট কাটার নির্দেশ দেয় বাফুফেকে। ১০ ডিসেম্বর মোহামেডান বাফুফেতে নিজেদের পাওনা সমন্বয় করে মোট ১৯ লাখ ১০ হাজার ৩১০ টাকা পরিশোধ করেছে। মোহামেডানের ডিরেক্টর ইন চার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন এমেকা ক্লাবকে বিপাকে ফেলে স্বার্থ হাসিল করেছেন, ‘আমাদের কাছে সব কাগজ আছে। এমেকা কোনো টাকাই পাবেন না। ফিফা না হলে আমরা যুদ্ধ করতাম।’

শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের দণ্ড
সাবেক বিদেশি কোচ ও খেলোয়াড় ফিফার কাছে অভিযোগ তোলায় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সাবেক চ্যাম্পিয়ন শেখ রাসেলকে অর্থদণ্ড দিতে হয়েছে দুবার। ২০১৫ সালে ক্লাবটির কাছে ৩ হাজার মার্কিন ডলারের (২ লাখ ৪৮ হাজার ৯২২ টাকা) দাবিতে অভিযোগ করেন সাবেক মেসিডোনিয়ান কোচ জর্জি জোভনাভস্কি। এ বছরই সেটি পরিশোধ করেছে শেখ রাসেল। ২০১৫ সালে সার্বিয়ান খেলোয়াড় মিরোস্লাভ সাবানাভিচ বকেয়া বেতন বাবদ ৪ হাজার ১২৬ মার্কিন ডলার (৩ লাখ ৪২ হাজার ৩৫১ টাকা) চেয়ে ফিফায় নালিশ করেন। ফিফার নির্দেশে পাওনা পরিশোধ করতে দুই বছর সময় নিয়ে ফেলে শেখ রাসেল। এতে আরও ১ হাজার ৫০০ সুইস ফ্রাঁ (১ লাখ ২৫ হাজার ৬৭৫ টাকা) জরিমানা এবং লিগ থেকে ক্লাবটির ৩ পয়েন্ট কেটে নেওয়ার নির্দেশ দেয় ফিফা গত ২৮ সেপ্টেম্বর। কিন্তু পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে গত ২১ নভেম্বর। অর্থাৎ টাকা দিয়েও ৩টি পয়েন্ট কাটা ঠেকাতে পারছে না শেখ রাসেল।

আবার ২০ হাজার ৪৯ ডলার (১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৬ টাকা) বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে শেখ রাসেলের বিরুদ্ধে গত ৩ আগস্ট ফিফার কাছে অভিযোগ করেছেন ক্যামরুনিয়ান খেলোয়াড় পল এমিলি। ২৪ নভেম্বর বাফুফের মাধ্যমে এই অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে ফিফা। তবে আপিলের সুযোগ থাকায় ৮ ডিসেম্বর আপিল করেছে শেখ রাসেল। ক্লাবের ডিরেক্টর ইন চার্জ ইসমত জামিল আখন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পল এমিলি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ক্লাবের স্পোর্টস ডিরেক্টর সালেহ জামানের সই জাল করেছেন তিনি। আমরা মানহানির ক্ষতিপূরণস্বরূপ উল্টো তাঁর কাছে ১ লাখ ডলার দাবি করেছি।’

আবাহনীর জরিমানা
২০১৬ এএফসি কাপে কলকাতার মোহনবাগানের বিপক্ষে ম্যাচে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে পর্যাপ্ত চিকিৎসা-সুবিধা ছিল না—এই কারণে ম্যাচ কমিশনারের প্রতিবেদনে আবাহনী অভিযুক্ত হয় এএফসির কাছে। গত ১৩ জুলাই আবাহনীকে এএফসিকে ২০ হাজার মার্কিন ডলার (১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৪৮০ টাকা) জরিমানা করলে তারা তা তিন কিস্তিতে শোধ করেছে। এর আগে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এএফসি প্রেসিডেন্টস কাপে আবাহনী বনাম চীনা তাইপের ক্লাব হাসুস এনটিসিপিই ম্যাচে ভিআইপি বক্স থেকে অজ্ঞাত এক দর্শক একটি পানির বোতল ছুড়ে মারেন মাঠে। সে জন্য গত বছর ৫ হাজার মার্কিন ডলার (৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৭০ টাকা) জরিমানা দিতে হয়েছে দেশের পেশাদার লিগের সফলতম দলটিকে। দলের ম্যানেজার সত্যজিৎ দাশ রুপু বলেন, ‘আমাদের এভাবে জরিমানা করাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কিছু করার নেই, এএফসির নির্দেশ মানতেই হবে।’

শেখ জামাল ধানমন্ডির আইনভঙ্গ
এএফসি কাপের একটি ম্যাচ শেষে ম্যাচের ভিডিও সময়মতো পাঠানো হয়নি বলে ২০১৪ সালে শেখ জামাল ধানমন্ডিকে ৩ হাজার ডলার (২ লাখ ২৯ হাজার ৭৪০ টাকা) জরিমানা করে এএফসি। এরপর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এএফসি কাপের সেমিনারে শেখ জামালের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকায় এএফসি ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ আরও ১০ হাজার ডলার জরিমানা করে তাদের। ক্লাবটি গত বছর জরিমানার অর্থ শোধ করে দিয়েছে।

খোদ বাফুফেই কাঠগড়ায়
মেয়াদ শেষের প্রায় দুই বছর আগে বরখাস্ত করায় হল্যান্ডের কোচ রেনে কোস্টার ৮০ হাজার ইউরো (৭৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৯৫ টাকা) বকেয়া চেয়ে বাফুফের বিরুদ্ধে এ বছরের ২৮ জুন অভিযোগ করেন ফিফার কাছে। ১৪ আগস্ট ফিফার রফা অনুযায়ী কোস্টারকে ৪১ হাজার ইউরো (৩৯ লাখ ৯২ হাজার ৬৮০ টাকা) পরিশোধ করেছে বাফুফে। ডাচ গোলরক্ষক কর্নেলিয়াস কালক্ গত ৭ সেপ্টেম্বর বকেয়া বেতন বাবদ ৪ হাজার ৭৭৪ ডলার চেয়ে (৪ লাখ ৬২ হাজার ৩৭১ টাকা) বাফুফের বিরুদ্ধে নালিশ করেন ফিফায়। ফিফা ওই টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয় গত ১০ অক্টোবর।
দেশের ফুটবলের অভিভাবক বাফুফেই খেলাপি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি অধীন ক্লাবগুলোর মধ্যে প্রভাব ফেলে কি না, এ নিয়ে মত চাইলে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজনের দেখাদেখি তো কেউ খেলাপি হয় না। ফিফার আইন সবাইকেই মানতে হবে। বাফুফে খেলাপি হয়েছে, কারণ ওই সময় বাফুফের টাকা ছিল না।’

কী করতে হবে 
কাজী সালাউদ্দিন বলেছেন, ‘আমরা অনেকেই আইন মানতে চাই না। কিন্তু মনে রাখতে হবে ফিফা একটা আইনে চলে, ২১১টি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের জন্যই সেই আইন সমান। আইন ভাঙার প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’ শেখ রাসেলের ডিরেক্টর ইন চার্জ ইসমত জামিল আখন্দ বলেন, বাফুফে ক্লাবগুলোর সঙ্গে বসে বিদেশি ক্লাব বা কোচ নিয়োগের চুক্তিপত্র-সংক্রান্ত একটা নির্দেশনা দিতে পারে। দেশের মানসম্মান যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেটি নিবিড়ভাবে দেখা উচিত বাফুফের।

 

প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email