দেখেও কেন দেখছেন না সু চি?
এবিসি : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আলোচনায় যোগ দেননি মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার যে অভিযোগ উঠেছে, সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তাঁর দেশে থাকা দরকার।
সাধারণ অধিবেশনে যোগ না দিয়ে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ সময় নেত্রী অং সান সু চিকে বিবিসির এক প্রতিবেদক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞকে কি আপনি সমর্থন করেন?’ সু চি পায়চারি করেছেন, চিন্তা করেছেন, কিন্তু প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
জাতিগত নিধনযজ্ঞে নীরবতা এবং বিভিন্নভাবে নিধনযজ্ঞকে সমর্থনে ভাষণ দেওয়ার পর মিয়ানমারের নেত্রী সু চি সারা বিশ্বে সমালোচিত হন। সারা দেশে তাঁর ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, দেশটির ক্ষমতায়ও আছেন; অন্যদিকে শান্তিতে তিনি নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। তাই পুরো বিশ্ববাসীর মনেই এখন প্রশ্ন, একজন ক্ষমতাবান ও ‘শান্তিপ্রিয়’ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে নীরব কেন সু চি?
সু চি কেন নীরব?
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের কাছ থেকে সু চির বাবার নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা পায়। তারপর দেশে সেনা শাসনসহ রাজনৈতিক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সু চির পরিবারসহ পুরো দেশকে। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠা এবং মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা সু চিকে একপর্যায়ে গৃহবন্দি করে সামরিক জান্তা সরকার। ১৫ বছরের বেশি গৃহবন্দি থাকার পর ২০১০ সালে মুক্তি পান সু চি। এর দুই বছর আগে ২০০৮ সালে সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দেশটির জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসে এবং এর মধ্য দিয়ে পতন হয় দীর্ঘ সেনা শাসনের।
সু চির দল ক্ষমতায় গেলেও তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কারণ ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল অ্যামিসকে (১৯৯৯ সালে তিনি মারা যান) বিয়ে করায় দেশটির নিয়ম অনুযায়ী সু চি ও তাঁর দুই সন্তান কখনো মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। দেশে এ রকম নিয়ম থাকায় বাধ্য হয়েই সু চিকে তাঁর অনুগামী একজনকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসাতে হয়।
দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ক্ষমতায় রয়েছে সু চির দল। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সু চি সারা বিশ্বে ব্যাপক সমালোচিত হলেও তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। রোহিঙ্গারা নিধনযজ্ঞের শিকার হলেও অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর এই সহিংসতা চলছে না। তাই দেশে বসবাসকারী প্রায় ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর কাছেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
তারপরও বলতে হয়, গণতান্ত্রিক মিয়ানমারে সু চির দল এনএলডি ক্ষমতায় থাকলেও দেশটির সংসদের পুরো নিয়ন্ত্রণ তাঁর দলে হাতে নেই। সংসদে সামরিক বাহিনীর জন্য কোটা বরাদ্দ রয়েছে। কোটার ভিত্তিতে সামরিক বাহিনী সংসদের ২৫ ভাগ আসন পেয়ে থাকে। গত সংসদীয় নির্বাচনে বিষয়টি আরো প্রকাশ্যে আসে। প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় -বর্তমানে এই প্রধান তিনটি মন্ত্রণালয়ই নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সেনাবাহিনী। অস্ত্র ও সীমান্তের পুরো নিয়ন্ত্রণ সেনাপ্রধানের হাতে।
সেনা নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মূলত পরিচালিত হয় জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের অধীনে। জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগই দেশটির জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, ভূমি ক্রয়বিক্রয়, শুল্কসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে। ৬০ হাজারের বেশি গ্রাম এই বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। তাই কোনো জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সরকারের পাশাপাশি সেনা নিয়ন্ত্রিত এই বিভাগও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেখানে সেনাবাহিনীকে বাদ দিয়ে সরকারের একার পক্ষে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছা সম্ভব নয়।
প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদে বাকি বিষয়গুলো মিয়ানমার সরকার বা সু চির এনএলডি দেখলেও দুর্নীতি বা অন্য অপরাধ বিষয়েও সেনা সমর্থন ছাড়া তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছা সহজ নয়।
মিয়ানমারের সামরিক সেনারা রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও স্থানীয় বৌদ্ধদের নিয়ে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে নেমেছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও সেনাপ্রধানকে টলতে দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টিকে তারা জাতীয় সুরক্ষা হিসেবেই দেখছে।
এরকম পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কাউন্সিলের সঙ্গে সু চি একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছেন। না হলে যেকোনো সময় দেশের ক্ষমতাধর সেনারা সু চিকে উৎখাত করে পুনরায় দেশটির ক্ষমতা দখল করতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। ফলে মিয়ানমারের কার্যত নেতা হলেও সু চি রোহিঙ্গাসহ দেশটির অন্য জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাসহ সার্বভৌমত্বের বিষয়টি তাঁর হাতে নেই, পুরোটাই সামরিক বাহিনীর হাতে।