কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক হিসাবে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে মোট তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে তারল্য সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগস্ট শেষে ব্যাংকিং খাতে অলস পড়ে আছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা গত এপ্রিল শেষে ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। ফলে গত চার মাসেই উদ্বৃত্ত তারল্য বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণ এই অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেনি। কিন্তু এই অর্থের আমানতকারীকে ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট অঙ্কের সুদ দিতে হয়েছে। এতে করে অন্যান্য ঋণের ওপর ব্যাংককে অতিরিক্ত সুদ আরোপ করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিনিয়োগ করতে না পারায় ব্যাংকগুলোর কাছে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। এসব অর্থের বিপরীতে তারা নিয়মিত সুদ গুনলেও কোনো আয় করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে আমানতের তুলনায় ঋণে সুদহার ধীরে ধীরে কমাতে হবে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন করে ব্যাংক ঋণ নেবে। কারণ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা এখনও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বর্তমানে শিল্প ও বাণিজ্যে ঋণের প্রবাহ আগের তুলনায় কমে গেছে। লোকজনের ব্যাংকঋণের চাহিদাও কমে গেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ সঞ্চয়পত্র ক্রয় করছে। ফলে ব্যাংকের তারল্য সম্পদ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট তরল সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা, যা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সম্পদ বেড়েছে ১৩ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষায়, এই অর্থের বড় অংশই সরকারের সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা আছে। আর এর থেকে ব্যাংকগুলো সুদ পাচ্ছে। সুতরাং এই অর্থ অলস বলা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকগুলো জনগণের কাছ থেকে ৬ শতাংশে আমানত সংগ্রহ করছে। অথচ সরকারি সিকিউরিটিজ ও বন্ডে সুদহার ৩ শতাংশের নিম্নে অবস্থান করছে। এতে করে ব্যাংকগুলোর এই অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে ধরা উচিত হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে দেখা যায়, তরল সম্পদের ৭৩ শতাংশই দায়হীন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা আছে। এতে মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর নগদ ও সংবিধিবদ্ধ তারল্যের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা আছে ৬০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, যা মোট তরল সম্পদের ২৩ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর নিজস্ব সিন্দুকে রাখা আছে ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ মন্দা চলছে। ধারণা করা হয়েছিল, রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। এক মাসে বিনিয়োগ সামান্য বাড়লে পরের মাসে এসে আবার কমে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অক্টোবর শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে নিম্নগতির মধ্যেও ছিল ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ। এদিকে বেসরকারি খাতে গত অর্থবছর শেষে আশা জাগালেও চলতি অর্থবছরে টানা পতন চলছে। তথ্যে দেখা যায়, জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা অক্টোবর শেষে ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ বিদেশ থেকে সরাসরি সহজ শর্তে ও তুলনামূলক সুবিধাজনক সুদে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েছে। এতে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগযোগ্য তহবিল অলস পড়ে আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মুদ্রা জোগান আগের প্রান্তিকের তুলনায় ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯ লাখ ৩১ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে মুদ্রা জোগান বেড়েছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, নিট বৈদেশিক সম্পদ ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা দাঁড়ায়। এতে মুদ্রা জোগান অনেক বেড়ে গেছে। তথ্যে আরও দেখা যায়, আলোচ্য প্রান্তিকে জনগণের হাতে থাকা নোট ও ধাতব মুদ্রা ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ কমে গেছে, যদিও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ২৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।