নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, নাসিরনগরের কিছু হিন্দু নেতা ও গণমাধ্যমের উপর অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন সংসদ সদস্য ও মৎস্য, প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে নাসিরনগর ডাক বাংলোতে অনুষ্ঠিত ঘণ্টব্যাপী বৈঠকে নাসিরনগরের সংসদ সদস্য ছায়েদুল হক- রানা দাশগুপ্ত, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নাসিরনগর উপজেলা শাখার সভাপতি আদেশ চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সুজিত চক্রবর্তীর উপর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চবাচ্য করেন। বৈঠকটি ছায়েদুল হক ব্যক্তিগত উদ্যোগেই আয়োজন করেন। এতে ডাকা হয়- স্থানীয় কিছু হিন্দু নেতা, হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হিন্দুদের। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল-অর্ধশতাধিক। এক ঘণ্টা ১০ মিনিট স্থায়ীত্বের বৈঠকটির একটি অডিও রেকর্ড এসেছে আমাদের সময় ডটকমের কাছে। বৈঠকে রানা দাশগুপ্তের প্রসঙ্গ উঠে, আজ শুক্রবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও পূজা উদযাপন পরিষদ আহূত মানবন্ধন-বিক্ষোভ সমাবেশ; ছায়েদুল হক হিন্দুদের মালাউন বলে সম্বোধন করেছেন- রানা দাশগুপ্তের এমন অভিযোগ এবং এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে। ৩ নভেম্বর ভোরের কাগজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রীসহ সবাইকে বৈঠকেই পড়ে শোনান মন্ত্রীর এপিএস মিজানুর রহমান। মিজান পড়েন- গত মঙ্গলবার রাতে নাসিরনগরের ডাকবাংলোতে স্থানীয় সংখ্যালঘু নেতাদের উদ্দেশ্য করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক বলেন, মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। আর এ ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে অতিরঞ্জিত করেছে সাংবাদিকরা। অথচ ঘটনা কিছুই নয়। সরেজমিনে দেখা যায়, রঙিন, হাফ হাতা গেঞ্জি পরিহিত এপিএস মিজানুর রহমান মন্ত্রীর বাম পাশে বসে পড়ছিলেন এসব। এসময় খানিকটা শোরগোল বাঁধে বৈঠকখানায় ছায়েদুল হকসহ বৈঠকে উপস্থিত অন্যরা রাগ্বত স্বরে কথা বলতে শুরু করেন। কিন্তু সবাইকে শান্ত হবার আহ্বান জানিয়ে মিজানুর রহমান মন্ত্রীকে বলেন, স্যার, আরো শোনেন, কী লেখছে। মিজান পড়ে শোনান, নাসিরনগরের সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিস্থিতি দেখতে গতকাল (বুধবার) সেখানে যান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। সংখ্যালগঘু নেতারা তাকে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে মন্ত্রী ছায়েদুল হকের কর্মকা-ও তুলে ধরেন। এরপর রানা দাশগুপ্ত বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় থাকতে একজন মন্ত্রী হিন্দুদের নিয়ে এই কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য কীভাবে করলেন? এতে জাতি বিস্মিত। তিনি জানান, মন্ত্রীর এমন বক্তব্য, হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে আগামীকাল শুক্রবার (আজ) হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ যৌথভাবে দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে। পাশাপাশি পুরো বিষয়টির বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছে। এসময় কাঠের চেয়ারে, সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত বসে থাকা মন্ত্রী ছায়েদুল হক ক্ষিপ্ত হয়ে উচ্চস্বরে বলেন, এই কথা রানা দাশগুপ্ত পাইলো কই। সব ওই দপ্তরির পুত আদেইশ্যা ও সুজিত্তার কাম (আদেশ চন্দ্র দাস ও সুজিত চক্রবর্তী)। আমি নাকি ওগোরে মালাউনের বাচ্চা কইছি। উনি (রানা দাশগুপ্ত) তো আমারে জিগাইতে পারতো। আমি সরকারের দায়িত্বশীল লোক। ভোরের কাগজ থেকে মিজান আরও পড়েন, তবে সংখ্যালগঘুদের নিয়ে ওই ধরনের বক্তব্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ছায়েদুল হক। গতকাল (বুধবার) সন্ধ্যায় ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, রানা দাশগুপ্ত কোথায়, কার কাছে এমন কথা শুনে এসব বানোয়াট কথা বলল, তা তাকে বলতে হবে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, রানা দাশগুপ্ত নাসিরনগর এসে আমার বিরুদ্ধে এই কথা বলে চলে গেল কেন? কেন সে আমার সঙ্গে দেখা করে সরাসরি এই কথা বলল না? দায়িত্বপূর্ণ একটি পদে থেকে একজন মন্ত্রীর সম্পর্কে সে কী ধরনের কথা বলছে, সে কি তা জানে? এখন আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেননি কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে বলল, পরিদর্শন করিনি? আমি প্রতিদিনই আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছি। উল্লেখ্য, ঘটনার চার দিন পর গত মঙ্গলবার রাতে মন্ত্রী নাসিরনগরে আসেন। ভোরের কাগজ দেখে মিজান আরও পড়েন- মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর রানা দাশগুপ্তের কাছে বিষয়টি ফের জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থানীয় নেতাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছি। অভিযোগের পুনরাবৃত্তি আর করব না। দুপুরে নাসিরনগরের ওসিকে প্রত্যাহার এবং রাতে মন্ত্রীর ঘোষণা- ওসিকে প্রত্যাহার করা হবে না এমন প্রশ্নের জবাবে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ওসির সংশ্লিষ্টতা থাকায় প্রশাসন গতকাল (বুধবার) দুপুরে তাকে প্রত্যাহার করে। কিন্তু রাতে মন্ত্রী ওসিকে প্রত্যাহার করবেন না এমন ঘোষণা শুনে জাতি স্তম্ভিত হয়ে গেছে। আর এতেই বোঝা যায়, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে- সেটি সঠিক। ছায়েদুল হক বৈঠকে উচ্চস্বরে বলেন, আমার মন্তব্যের প্রতিবাদে মানবন্ধন ডাকছে। আইচ্ছা, আপনেরাই কন, আমি কী জীবনে আপনেগোরে মালাউন কইছি? স্বমস্বরে অনেকেই না বোধক উত্তর দেন। ছায়েদুল হক বলেন, বুচ্ছেন, জংলী (জঙ্গি) ঢুকছে। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলতাছে। বুঝেননি আপনেরা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিপদে ফালাইতে এইসব চক্রান্ত। এসময় সমস্বরে সবাই মন্ত্রীর কথায় সায় দেন। বৈঠকে ভোরের কাগজের নাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন সিনিয়র সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে গণমাধ্যমের উপরও চরম ক্ষোভ ঝাড়েন মন্ত্রী ছায়েদুল হক। মন্ত্রী ছায়েদুল হকের ‘মালাউন’ শব্দ প্রয়োগের বিষয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নাসিরনগর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুজিত চক্রবর্তী বৃহস্পতিবার রাতে আমাদের সময় ডটকমকে বলেন, এটা যদি বানানো হয়, তবে টিভিতে ভিডিওসহ কীভাবে দেখা ও শোনা গেল?