বুধবার, ১৪ই নভেম্বর, ২০১৮ ইং ৩০শে কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

তিন উপজেলার সীমান্তে পাচার হচ্ছে নিত্যপণ্য, আসছে মাদক!

1

মাসুকুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি : দেশের পুর্বাঞ্চল তথা চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোরাচালানি পণ্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলো দিয়ে। এসব সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ, ছোট মাছ, চাষ ও বিপণণ নিষিদ্ধ পিরানহা মাছ, ডিম, আলু, তেল, সার, কাপড়ের গাইড, তামাকাসা ও সাবানসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে সীমান্তের ওপার থেকে বানের জলের মতো আসছে ফেন্সিডিল, ইয়াবা, হিরোইন, গাঁজা, মদ, বিয়ার, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট ও গোলা বারুদ।

পরে এসব মাদকদ্রব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাচারের সুবিধার্থে সীমান্তবর্তী ওই তিন উপজেলা ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই উপজেলাগুলোর উপর দিয়ে চলাচলকারি সকল আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনগুলো এসব মাদক পাচারের প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সড়ক পথে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসে করেও ঢাকাসহ সারা দেশে মাদক পাচার হচ্ছে।

2এছাড়া এসব উপজেলার সীমান্তবর্তী অন্তত ৫০ টিরও বেশি গ্রামের পাঁচ শতাধিক স্পটে অবাধে চলছে ফেন্সিডিল, ইয়াবা, হিরোইন, গাঁজা, মদ ও বিয়ার জাতীয় মাদকের রমরমা ব্যবসা। রেল ও সড়ক পথে প্রতিদিন শত শত যুবক সস্তায় মাদক সেবন করতে আসছে এসব এলাকায়।

অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, আখাউড়া সীমান্তের আজমপুর, কুড়িপাইকা, ধলেশ্বর, বাউতলা, কালিকাপুর, জয়নগর, ইটনা ও কর্মমঠ এবং বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল, মিরাসানি ও বিষ্ণুপুর এলাকা মাছ পাচার ও মাদক চোরাচালানের ঘাট হিসেবে পরিচিত। এসব সীমান্তে প্রতিদিন ছোট পিকআপ ভ্যানে ভর্তি করে বিপুল পরিমাণ মাছ জড়ো করা হয়। সেখানে কাঁটাতারের বেড়ার নিচে পানি চলাচলের জন্য দেওয়া কংক্রিটের মোটা পাইপের ভেতর দিয়ে, কখনো কাঁটাতারের পকেট গেট দিয়ে মাদক আনা হয় বাংলাদেশে।
এদিকে কসবা সীমান্ত দিয়ে মাদক চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট পয়েন্টগুলো হচ্ছে উপজেলার ধজনগর, পাথারিয়াধার, সুতারমুড়া, লক্ষীপুর, কুইয়াপানিয়া, খিরনাল, আকুবপুর, তারাপুর, হাঁকর, চকবস্তা, উমরপুর, পুটিয়া, খাদলা, শ্যামপুর, বেলতলী, গোপীনগর, নন্দনগর, কাশিরামপুর, রঘুরামপুর, গৌরাঙ্গলা, সস্তাপুর ও মির্জাপুর। ওই সব সীমান্ত পথ দিয়ে সহজেই নামানো যায় চোরাচালানি পণ্য।

3কসবা সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা জানান, কাশিরামপুর সীমান্ত দিয়ে চোরাচালানি পণ্য সীমান্তের ওপারের বালিউড়া, রঘুরামপুর হয়ে চলে আসে মন্দভাগ রেলষ্টেশনে। এছাড়া কসবার পুটিয়া, বেলতলী ও গৌরাঙ্গুলা হয়ে আসা চোরাচালান পণ্যগুলো সালদা রেলষ্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এসব মাদকদ্রব্য স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রীসহ এলাকার যুবক ও মধ্যবয়সীরা সেবন করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের কারণে কসবার পূর্বাঞ্চল সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর শত শত অভিভাবক উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মহাবিপদে পড়েছেন।    

4জানা গেছে, কসবা ও আখাউড়া সীমান্তে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কথিত সংঘবদ্ধ লাইনম্যানরা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় থেকে মাদক চোরাচালান ব্যবসা করছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। ফলে সীমান্তবর্তী প্রতিটি গ্রামে গড়ে উঠেছে মাদকদ্রব্য বিক্রির আস্তানা। তাছাড়া থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গাঁজা, ইয়াবা, বিদেশী মদ, ফেনসিডিল, বাংলা মদসহ পাচারকাজে জড়িত আসামি গ্রেফতার করলেও স্থানীয় গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন।

মাদক পাচারে লাইনম্যান : 

অভিযোগ রয়েছে, আখাউড়া রেলওয়ে ষ্টেশনে জিআরপি পুলিশ, ডিবি পুলিশ,  রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও বিজিবির নামে টোকেনের মাধ্যমে টাকা নেয়া হয়। টাকা তোলার কাজটি করেন  স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘লাইনম্যানরা’। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ম্যানেজ করার দায়িত্বে থাকা এসব লাইনম্যানরা সিন্ডিকেট করে টোকেন দিচ্ছেন। টোকেনের বিনিময়ে ওঠা টাকা তারা ভাগ বাটোয়ারা করেন।

অভিনব ‘টোকেন’ প্রথা :

অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে,  স্থানীয় আইন প্রয়োগকারি সংস্থার অসাধু সদস্যরা বিশেষ ‘টোকেন’ এর মাধ্যমে মাদক পাচারে সহযোগিতা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আখাউড়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত মাদক নিতে চারটি বিশেষ চিহ্ন সংবলিত টোকেন দেওয়া হয়। বিনিময়ে মাদকের পরিমাণ অনুযায়ী টাকা নেওয়া হয়।
জানা যায়, ট্রেনে  মাদক পাচার করতে ‘মোরগ’, ‘ফুটবল’, ‘মাছ’, ‘গোলাপ ফুল’- এ চারটি প্রতীক সংবলিত টোকেন ব্যবহার করা হয়। ছোট কাগজ সম্বলিত টোকেনের এক পিঠে দেওয়া থাকে প্রতীকের সীল অন্য পিঠে মাদকের পরিমাণ।
কয়েকজন চোরাকারবারির সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আখাউড়া থেকে ভৈরব যেতে-‘মাছ’ প্রতীকের সীল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে ‘গোলাপফুল’, নরসিংদী যেতে ‘ফুটবল’ এবং কমলাপুর (ঢাকা) যেতে ‘মোরগ’ প্রতীকের সীল ব্যবহার করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এসব টোকেন দেখলে মাদক পাচারকারীদের নির্বিঘেœ যেতে ব্যবস্থা করে দেন।
বখরা’র  রেট :

কয়েকজন চোরাকারবারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতি বোতল ফেন্সিডিল আখাউড়া থেকে ঢাকা নিতে খরচ দিতে হয় ৪৫-৫৫ টাকা। প্রতি কেজি গাঁজা পরিবহনের খরচ দিতে হয় ৮’শ থেকে এক হাজার টাকা। ওই চারটি টোকেন নেওয়ার মাধ্যমেই তারা টাকা দিয়ে থাকেন।
মাদক চোরাচালানের বিষয়ে জানতে চাইলে কসবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান গোপনে কিছু মাদকদ্রব্য সীমান্তের ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসার কথা স্বীকার করে বলেন, কসবায় এখন আগের মতো মাদক নেই বললেই চলে। মাদকের বিরুদ্ধে আমার থানায় গত জুন মাসে ২৩টি, জুলাইয়ে ২৪টি ও চলতি (আগস্ট) মাসে ১১টি মামলা হয়েছে। আমরা মাদকসহ চোরাচালানিদের ধরছি সমানে। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে এটা বলবো না, তবে আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
এ বিষয়ে আখাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাম্মাদ হোসেন বলেন, মাদক যাতে আখাউড়া থেকে নির্মূল করা যায় সেজন্য আমরা নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রাখছি। বিজিবি যদি আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে তাহলে আমরা মাদক নির্মূল করতে পারবো।
এ বিষয়ে বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রসুল আহমেদ নিজামী বলেন, গত দুই মাসে মাদকের বিরুদ্ধে আমার থানায় ৬০টিরও বেশি মামলা হয়েছে। মাদক পুরোপুরি বন্ধ করতে বিজিবির শক্তিশালী ভূমিকা ও সহযোগিতা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান মাদক পাচার রোধে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘শুধু সীমান্তবর্তী এলাকা নয়, জেলায় মাদকের জিরো টলারেন্স দেখাতে আমি বদ্ধ পরিকর। এখানে যোগদানের পর আমি সকল কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছি। সবাইকে দিক নির্দেশনা দিয়েছি। মাদক পাচার, মাদক সেবন চলবেনা। এ লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি’।