বাংলাদেশ সহ ১১ দেশের হাজারকোটি টাকা চুরি করেছে উত্তরকোরীয় হ্যাকাররা
উত্তর কোরীয় একটি হ্যাকার গ্রুপ সারা পৃথিবীর ব্যাংকিং খাত দাবড়ে বেড়াচ্ছে। একের পর এক সাইবার আক্রমণ করে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। রয়টার্সের একটি বিশেষ প্রতিবেদনে এই খবর দেওয়া হয়েছে।
গত চার বছরে এই হ্যাকাররা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এক দশমিক এক বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের একশ মিলিয়ন ডলার নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা হিসেব থেকে ‘হ্যাক’ করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যে ৪০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্রুত হস্তক্ষেপে এরই মধ্যে ফেরৎ পাওয়া গেছে।
ঐ প্রতিবেদনে সাইবার নিরাপত্তা তদন্ত সংস্থা ‘ফায়ার আই’কে উদ্ধৃত করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১১টি দেশের ষোলটি সংস্থা এই আক্রমনের শিকার হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ব্যাংকগুলোকে আরো সাইবার আক্রমন হতে পারে বলে সতর্ক করেছে।
‘ফায়ার আই’-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট চার্লস কারমাকাল বলেছেন যে, ‘উত্তর কোরীয় হ্যাকাররা ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। তারা ব্যাংক থেকে অর্থ চুরির আগে গড়ে অন্তত ১৫৫ দিন অপেক্ষা করে। ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো মাথায় রেখে তারা তাদের এই আক্রমনের দিনক্ষণ এবং স্থান নির্ধারণ করে।’
গত জানুয়ারি মাসে মেক্সিকোর কয়েকটি ব্যাংকে তারা আক্রমন করে এবং এক কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়। চার্লস কারমাকাল আরো জানিয়েছেন যে এই গ্রুপ ‘যে বাড়ি আক্রমণ করে তা পুড়িয়ে দেয়’। একথা বলে তিনি বুঝিয়েছেন যে তাদের আক্রমণের ডিজিটাল পদচিহ্ন মুছে ফেলার জন্যে তারা কম্পিউটার হার্ড ড্রাইভ থেকে সকল তথ্য দূর থেকেই মুছে ফেলার কৌশল অর্জন করেছে।
‘ফায়ার আই’ আরো জানিয়েছে যে চতুর এসব সাইবার হামলাকারীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার লোভে কার্যকর আক্রমণ করে থাকে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্কের ফেডে রাখা হিসাব থেকে তারা এভাবেই সুইফ্টের মাধ্যমে অনেকগুলো ভূঁয়া নির্দেশনা দিয়ে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হাতিয়ে নেবার উদ্যোগ নিয়েছিল। এর মধ্যে যাচাই না করেই কয়েকটি নির্দেশনা কার্যকর করে ফেড। সে কারণেই একশ মিলিয়ন ডলার বের হয়ে যায় তাদের হিসেব থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত তৎপর হবার কারণে শ্রীলংকা থেকে বিশ মিলিয়ন ডলার ফেরৎ আনা সম্ভব হয়। আরও বিশ মিলিয়ন ডলার ফিলিপিনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ফেরৎ এসেছে। বাদবাকী অর্থ ফেরৎ আনার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নিউইয়র্কে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ প্রশ্নে সরকারি অনুমোদন পাওয়া গেছে বলে অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালতে উত্তর কোরীয় ঐ গ্রুপের একজনের নামে (পার্ক জন) মামলা করেছে। সংশ্লিষ্ট মহল আশা করছেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক দেরিতে হলেও আঁটঘাঁট বেঁধেই এবারে মামলা করবে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রয়োজনীয় আইনী মতামত সংগ্রহ করেছেন। তাছাড়া, তাদের হাতে এখন এফবিআই প্রতিবেদনসহ আরো অনেক নির্ভরযোগ্য তথ্য উপাত্ত আছে। অনুমান করা যায় ফিলিপিনের আরসিবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধেই এই মামলা হবে।
কেননা, প্রচলিত এন্টি-মানিলন্ডারিং আইন-কানুন উপেক্ষা করেই ঐ নষ্ট ব্যাংকটি কেওয়াইসি (গ্রাহককে জানো) ছাড়াই ভূঁয়া হিসেব খুলে দুর্বৃত্তদের নগদে অর্থ পরিশোধ করেছে। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ অডিট প্রতিবেদনেও এ তথ্য বের হয়ে এসেছে। ঐ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিয়ম পালনে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে ব্যাংকটিকে একুশ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিষয়টিতে অতিমাত্রায় ‘রাজনীতিকরণ’, ‘অদক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন’ ও অযথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর দোষারোপ না করে আরো দ্রুত মামলাসহ অন্যান্য উপায়ে তৎপরতা চালানো গেলে এত দিনে হয়তো পুরে অর্থই ফেরৎ আনা সম্ভব হতো বলে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।