গ্রেনেড হামলা মামলা: কী পেলেন ‘সেই জজ মিয়া’?
বহুল আলোচিত ও চর্চিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাকে কেন্দ্র করে এক যুগেরও বেশ সময় আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)’র তদন্তে উঠে আসে ‘জজ মিয়া’ নামটি। এর পর রাতারাতি দেশবাসীর কাছে এই ‘জজ মিয়া’ হয়ে উঠেন বড় এক সন্ত্রাসী। দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোর শিরোনাম হন ‘জজ মিয়া’। গতকাল বুধবার (১০ অক্টোবর) ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো ভয়াল এই গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত।
৩৭ বছর বয়সী সেই জজ মিয়া এখন ঢাকার রিকশা চালক। এ বছরই বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। রায় ঘোষণার পর জজ মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রায়ে আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু যাঁকে সবাই এত দিন ধরে হামলার মূল হোতা বলেছে আদালত তাঁকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেন। আর আমাকে অকথ্য নির্যাতন করে যাঁরা মামলার গতিপথ ভিন্ন দিকে নিতে চেয়েছিল তাদেরও যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশের শেষ দিকে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন ঠিক তখনই তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হয় এই বর্বর গ্রেনেড হামলা। হামলা মামলার ১০ মাস পর রাজধানী থেকে ‘জজ মিয়া’ নামে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সিআইডি পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, তারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। জজ মিয়াকে সেই রহস্যের চাবি বানিয়ে তাকে সামনে নিয়ে আসা হয়। এর পর দিনের পর দিন তার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।
ন্যাক্কারজনক এই হামলা মামলার রায় ঘোষণার পর জজ মিয়া নিজের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে বলেন, ‘একটা মাস আমারে আটকায়ে রেখে কী যে মারা মারছে সিআইডি, বলার মতো না। যতক্ষণ না আমি সব স্বীকার করতে রাজি হইছি, ততক্ষণ চলছে নির্যাতন। অথচ আমি নিজে এই হামলার কিছুই জানতাম না। আমি সিআইডিকে বোঝাতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন নিরপরাধ হয়েও নির্যাতন সহ্য করেছি। এখনও সেই ব্যথা যায়নি। ডান হাতের হাড় ফেটে গিয়েছিল। মেরুদণ্ডের ব্যথাটা এখনো আছে। কী করুম, পেটের দায়ে তারপরও রিকশা চালাতে হয়।’
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, আদালতে হাকিমের খাসকামরায় গিয়ে সাজানো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কাগজে সই করার পর সিআইডির দুই কর্মকর্তা মুন্সী আতিক ও আব্দুর রশীদ জজ মিয়া ও হাকিমসহ বিরিয়ানি খান। এর পরই জজ মিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এ নিয়ে ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট ‘সাজানো জবানবন্দির পর জজ মিয়াকে নিয়ে আদালতে বিরিয়ানি খান তদন্ত কর্মকর্তা’ শিরোনামে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর আগে জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর ২০০৫ সালের ২৯ জুন ওই দৈনিকটিতে ‘সেই জজ মিয়া তারকা সন্ত্রাসী!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায, জজ মিয়ার জন্ম রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়। তার বাবা মৃত আবদুর রশিদ ছিলেন একজন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বোকারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামে তাদের আদি নিবাস। আবদুর রশিদের দ্বিতীয় সংসারের সন্তান ছিলেন জজ মিয়া। বাবার ব্যবসার সুবাদে জজ মিয়ার পরিবার প্রথমে তেজগাঁওয়ের তিব্বত বস্তি ও পরে নাখালপাড়া নূরানী মসজিদের পাশে থাকত। জজ মিয়া ছিলেন তিন ভাই ও দুই বোন। তাদের মধ্যে জজ মিয়া ছিলেন দ্বিতীয়।
নাখালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জজ মিয়ার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ওই স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। এর পর বাবা আবদুর রশিদ তাকে ভর্তি করান স্থানীয় মনু মিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। কিছুদিন পর বাবার মৃত্যুতে জজ মিয়ার পড়াশোনায় লাগাম পড়ে। বড় ভাই আলমগীরের সঙ্গে জজ মিয়াও নেমে পড়েন ভাঙাড়ি ব্যবসায়। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার।
ছেলেকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঢাকায় ভিডিও দোকানে কাজ করার সময় কিছু ছিঁচকে চোরের সঙ্গে জজের শত্রুতা হয়। তারাই তার ছেলেকে গ্রেনেড নিক্ষেপকারী বলে ধরিয়ে দিয়েছে। আর সিআইডি সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে।’
এমনকি তৎকালীন সময়ে নোয়াখালীর সেনবাগে জজ মিয়ার গ্রামের লোকজনও বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে জজ মিয়ার মতো একজন সহজ-সরল যুবক এমন হামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
বুধবার আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা হলেও বিগত দিনে সরকারের পক্ষ থেকে জজ মিয়াকে কোনও ধরনের সহযোগিতা করা হয়নি। সিআইডির তদন্ত মিথ্যা প্রমাণ হওয়ায় তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। কিন্তু কে ফিরিয়ে দেবে জজ মিয়ার সেই দিনগুলো? এত নির্যাতনের পর জজ মিয়া কি পারবেন আর কোনও দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে? এসব অনেক প্রশ্ন এখন জজ মিয়ারও।
তবে মামলার রায় ঘোষণা হলেও আক্ষেপ আছে এই নির্দোষ মানুষটির। সেই আক্ষেপ নিয়েই জজ মিয়া বলেন, ‘মামলা তো শেষ। তয় নির্যাতন আর পত্রিকায় নাম উঠা ছাড়া আমি কী পাইলাম? এখন যদি সরকার আমার দিকে দয়ার দৃষ্টি দেয়, আমার বিষয়টা মানবিকভাবে দেখে।’
এমন প্রত্যাশা শুধু জজ মিয়ার একার নয়- তার পরিবার, স্বজন, আত্মীয়-পরিজন ও বোধসম্পন্ন মানুষেরও এখন এটিই চাওয়া।
সূত্র: ব্রেকিংনিউজ