‘নাকাব’ এ শেষ রাজশাহী নগরের বড় পর্দার
রাজশাহী মহানগরীর একমাত্র ও সর্বশেষ সিনেমা হল ‘উপহার’ এ প্রদর্শিত হচ্ছে শাকিব খান, নুসরাত ফারিয়া, সায়ন্তিকা অভিনীত ‘নাকাব’ সিনেমা। এ সিনেমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই শেষ হচ্ছে নগরের নিউমার্কেট এলাকার ঐতিহ্যবাহী একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ উপহারের পথচলা। আর আট ঘন্টা পরেই দীর্ঘ চার যুগের এই ‘হল’র ঘটবে যবনিকা।
বৃহস্পতিবার (১১ অক্টোবর) রাত ১২টা পর্যন্ত চলবে এর শেষ শো। এর সাথে শেষ হচ্ছে ‘উপহার’ হলকে ঘিরে ২২ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর জীবিকার পথ। পাশাপাশি হলকে ঘিরে অনেকের জীবন জীবিকার একটি ক্ষেত্র হারিয়ে গেল।
উপহার সিনেমা হলের ম্যানেজার তপন কুমার দাস বলেন, মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এ হলের শেষ শো চলবে। এর পর হলটি বন্ধ হয়ে যাবে। রাতেই হল বন্ধের নোটিশ দিয়ে দেয়া হবে বলে জানান উপহারের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, মন্দা ব্যবসার কারণেই রাজশাহীর সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে। এর অংশ হিসেবেই উপহারও বন্ধ হচ্ছে বলেও জানান তপন কুমার দাস।
১৯৯১ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী রাজশাহী নগরীসহ জেলায় সিনেমা হল ছিল ৫৫টি। তবে জেলায় বর্তমানে উপহারসহ চালু আছে মাত্র পাঁচটি সিনেমা হল। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উপহার। চালু থাকছে, পবার নওহাটার বাবুল, মোহরপুরের কেশরহাটের দিনান্ত, তানোরের আনন্দ ও বাগমারার মাদারিগঞ্জে অন্তরা।
রাজশাহী নগরের এক সময় জনপ্রিয় সিনেমা হল স্মৃতি (অলকা), উৎসব, বর্ণালী, লিলি ও উপহার। এসব সিনেমা হলের নামে এখনও এলাকার মোড়গুলোর নামকরণ রয়ে গেছে। নেই শুধু সিনেমা হলগুলোই। একে একে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শহরের একমাত্র উপহার সিনেমা হলটিতে সারা বছরই দর্শক সমাগম হতো।
নগরীতে প্রেক্ষাগৃহ ছিল ছয়টি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অলকা পরবর্তী নাম স্মৃতি, কল্পনা পরবর্তী নাম উৎসব, স্নিগ্ধা পরবর্তী নাম উপহার, বর্ণালী, লিলি। এছাড়াও নগরের উপকণ্ঠে কাটাখালীতে নতুন পরবর্তী নাম রাজতিলক এবং নওহাটায় দুইটির একটি নাম ছিল বাবুল ও অপরটি লিলি। এগুলোর মধ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রেক্ষাগৃহটি ছিল রাজশাহীর বর্ণালী সিনেমা হল। এর আসন ছিল এক হাজার ৩৭৩টি।
২০০৭ সালে শহরের সবচেয়ে পুরনো প্রেক্ষাগৃহ স্মৃতি সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে রাজশাহীর ভিক্টোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাবের উদ্যোগে নাট্য আন্দোলন এগিয়ে নিতে নির্মিত হয়েছিল ‘রাজা প্রমথনাথ টাউন হল’। প্রতিষ্ঠা থেকে সেখানে নিয়মিত বাংলা সাহিত্য ও নাট্যচর্চা হতো। ১৯১৯ সালের ২ এপ্রিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাছ থেকে হলটি কিনে নেয় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন। পরে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে অলকা সিনেমা হল নামে যাত্রা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে স্মৃতি সিনেমা হল নামে হলটির নামকরণ হয়। পরে ওই হল ভেঙে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন বহুতল ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে।
নগরীর আলুপট্টির উৎসব সিনেমা হলে ২০১০ সালের জুলাইয়েও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। পরে তা ভেঙে স্বচ্ছ টাওয়ার নামে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। নগরীর কাদিরগঞ্জ ও আমবাগানের মধ্যবর্তী এলাকায় ছিল বর্ণালী সিনেমা হল। বর্তমানে হলটি না থাকলেও শহরের ওই এলাকার নামকরণ রয়েছে বর্ণালীর মোড় নামেই। শহরের পাশেই মোল্লাপাড়ার লিলি সিনেমা হলটিও আর নেই। সেখানে করা হয়েছে মার্কেট।
উপহার সিনেমা হলের দারোয়ান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হলটি যখন প্রথম চালু হয়, তখন থেকেই এখানে কাজ করছি। হঠাৎ শুনতে পাই, হলটি বন্ধ হয়ে যাবে। তখন থেকেই চিন্তায় আছি। কারণ, অন্য কোনো কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই এবং ব্যবসা করার মতোও অর্থ নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি ড. সাজ্জাদ বকুল বলেন, বিভাগীয় একটি শহরে একটি সিনেমা হল থাকবে না, এটা একটি অশনিসংকেত।
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ডা. এফ এম এ জাহিদ বলেন, ‘এভাবে সব সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হলে নতুন প্রজন্ম সিনেমা হল আর কখনও চিনবে না; পরিচয়ও ঘটবে না। তাই ঐতিহ্য হিসেবে হলেও বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে একটি সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ জন্য সমাজের দায়িত্ববান কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।