শুক্রবার, ১২ই অক্টোবর, ২০১৮ ইং ২৭শে আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

কে এই ‘জজ মিয়া’

২০০৪ সালে ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২২ জনের মৃত্যু হয়। সে সময় এই হামলার নেপথ্যে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে আরেকটি নাম ‘জজ মিয়া’। এ ঘটনায় তদানীন্তন চার দলীয় জোট সরকার যে মামলা সাজায় তাতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করা হয়েছিল তাকে। মামলাটির অন্যতম আসামি ছিলেন তিনি। মামলায় তাকে হামলায় অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখানো হয়।

আলোচিত সেই মামলার রায় ঘোষণার জন্য বুধবার (১০ অক্টোবর) দিন ধার্য করেছে আদালত। পুরো জাতির অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে এই রায়ের মধ্যে দিয়ে।

কিন্তু, এতবড় ঘটনাটি নোয়াখালীর একজন সাধারণ মানুষ কী করে বাস্তবায়ন করলেন সেই সূত্র না মেলায় গোয়েন্দা সংস্থার সাজানো এই চিত্রনাট্যটি গণমাধ্যমসহ সব মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। হামলার শিকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলীয় রাজনৈতিক নেতারাও সাফ জানিয়ে দেন ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছেন জজ মিয়া। অবশেষে অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি পান জজ মিয়া, এখন এই মামলার অন্যতম সাক্ষীও তিনি।

কিন্তু আজও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েই গেছে কে এই জজ মিয়া?

গ্রেনেড হামলার প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করতে ২০০৫ সালের ১০ জুন নোয়াখালীর সেনবাগের বাড়ি থেকে জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকা জজ মিয়াকে প্রথমে সেনবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাকে ঢাকায় এনে নির্যাতন চালায়।

১৭ দিন রিমান্ডের পর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হামলার জন্য দায়ী করে রাজধানীর ১১ সন্ত্রাসীর নাম উল্লেখ করেন জজ মিয়া। এরা হলো- রবিন, শফিক, বকুল, হাশেম, লিংকন, আনু, মুকুল, সুব্রত বাইন, জাহিদ, জয় ও মোল্লা মাসুদ। জজ মিয়া বলেন, হামলায় নেতৃত্ব দেয় বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল। তবে এ জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। জজ মিয়া এও বলেছিলেন, গ্রেনেড ও বোমার পার্থক্যও তিনি জানেন না।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় যখন জজ মিয়াকে ফাঁসানো হয় তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর। নোয়াখালীর সেনবাগে ভিটেমাটি থাকলেও গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে পোস্টার ও ক্যাসেট বিক্রি করে কোনোমতে জীবিকা চলত।

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার সেই কথিত ‘প্রধান আসামি’ জজ মিয়া এখন ট্যাক্সি চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

তাকে মুক্ত করতে ছয় বছরের আইনি লড়াইয়ে সেই ভিটেমাটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল জজ মিয়ার পরিবার। তাকে মুক্ত করতে তার ভাই, বোন সবাই নিঃস্ব হয়ে গেছে। কারাগার থেকে মুক্তি মিললেও অতি কষ্টে দিন যায় তাঁর।

সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৯ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। কিন্তু ততদিনে জীবন থেকে চলে গেছে মূল্যবান পাঁচটি বছর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুনর্বাসনসহ চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর পর গেছে আরও আট বছর। এখন তার বয়স ৩৭ হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুত চাকরির দেখা পাননি জজ মিয়া। ধারের টাকা ফেরত দিতে মুক্তির বছরেই সাড়ে ৭ শতাংশ পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে এলাকা ছাড়েন জজ মিয়া।

দীর্ঘদিন কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। টাকা ধার নিয়ে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। সেই টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি। জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোরও চেষ্টা করেছিলেন জজ মিয়া। প্রাইভেট গাড়ি চালানো শুরু করেছিলেন তিনি। আড়াই বছর আগে বিয়েও করেন। কিন্তু পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনে ভেঙে যাওয়া হাড়গুলো জোড়া লাগলেও এখনো যন্ত্রণা দেয় তাকে। ওষুধে ব্যথা কিছুটা উপশম হলেও ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে।

নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বোকারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামের মৃত আবদুর রশিদের ছেলে জজ মিয়া। জন্ম ঢাকার তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়। বাবার ভাঙ্গারি ব্যবসার সুবাদে পরিবারের সঙ্গে প্রথমে তিব্বত বস্তি পরে নাখালপাড়া নূরানী মসজিদের পাশে থাকতেন। বাবার মৃত্যুর পর পঞ্চম শ্রেণি পাস জজ মিয়ার পড়াশোনা আর হয়নি। কিছুদিন বড় ভাই আলমগীরসহ বাবার ভাঙারি ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন। পরে রাজধানীর গুলিস্তানে হকারের কাজ করতেন।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২১ আগস্ট মামলার নতুন তদন্তের উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন নতুন অভিযোগ পত্রে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।

২০০৯ সালের ২২ জুন বাড়তি তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সে বছরই ৩ আগস্ট সিআইডির নতুন কর্মকর্তাদের যুক্ত করে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় জজ মিয়াকে, মুক্তি পান তিনি। কিন্তু সেই বিনা অপরাধে সেই বিভীষিকার সময়টি তিনি কখনোই ভুলবেন না, এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

তার স্বজনরা জানান, বিনা দোষে টানা চার বছর জেলের ঘানি টানতে গিয়ে প্রচুর দেনা হয়ে যায় তার। অভাব অনটনের সংসারে যারা সহযোগিতা করেছিলেন তারা প্রদেয় অর্থ ফেরত চাইলে ২০০৯ সালে নিজের সাড়ে ৭ শতাংশ পৈত্রিক জমি দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইদের কাছে ১ লাখ ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করে নোয়াখালী ছাড়েন জজ মিয়া।

নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন মৌচাক এলাকার একটি টিনসেড বাড়িতে দুই রুম নিয়ে বৃদ্ধা মা, ছোট বোন ও ছোট ভাইকে নিয়ে জালাল উদ্দীন ড্রাইভার ওরফে জজ মিয়া বসবাস করছেন। যদিও মাস ৩ আগে তিনি বসবাস করতেন রাজধানীর কদমতলী থানার রায়েরবাগ এলাকায়।

কিন্তু সেই এলাকার মানুষ তাকে ‘জজ মিয়া’ হিসাবে চিনে ফেলায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। ফলে তিনি বাসা পরিবর্তন করে বর্তমান ঠিকানায় চলে এসেছেন।

আলাপকালে জজ মিয়া ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমি জজ মিয়া নই’। আমি জালাল উদ্দীন। ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেন, দেখুন আমার ভোটার আইডি কার্ডে জালাল উদ্দীন নাম।

তিনি বলেন, ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তত্কালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঘাতকদের রক্ষা করতে আমাকে ‘জজ মিয়া’ বানানো হয়।

তিনি বলেন, আমি বর্তমানে কিস্তিতে একটি পুরনো প্রাইভেটকার কিনে নিজেই ড্রাইভিং করে সংসার চালাই। নামের কারণে আমি সবার কাছে হাসি-তামাশার পাত্র। তাই আমার কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতেও চায় না। বছর দুই আগে চাঁদপুরে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন পরে আমার স্ত্রী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন যখন জানতে পারেন আমিই সেই ‘জজ মিয়া’ তখন আমার স্ত্রীও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনি আরো বলেন, সত্যি কোনো দিনই চাপা থাকে না।

সূত্র: বিডি২৪লাইভ