২০৫০ সালের মধ্যেই ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশ
কার্বন নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ১২ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে খরা, বন্যা আর ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মতোমহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্বের নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানীরা।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে সতর্ক করেছে, এক্ষুণি পদক্ষেপ না নিলে ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে।
উষ্ণতা বৃদ্ধির বিপর্যয়পূর্ণ এই মাত্রা এড়াতে ‘সমাজের সবক্ষেত্রে দ্রুত, বহুদূরপ্রসারিত ও নজিরবিহীন পরিবর্তন অপরিহার্যতা হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছেন ওই বিজ্ঞানীরা।
তবে উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ঠেকানোর ওই চ্যালেঞ্জ বিশ্ব আদৌ মেটাতে পারবে কিনা তা নিয়ে নিঃসংশয়ী হতে পারছে না জাতিসংঘের প্যানেল।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।
জলবায়ু ইস্যুতে কয়েক বছর পর পরই প্রতিবেদন দেয় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি)। সবশেষ ২০১৪ সালে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল তারা। ওই পঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বিশ্বের জলবায়ু পরিস্থিতিকে কেবল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি বরং পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
সোমবার (৮ অক্টোবর) আইপিসিসি-এর পক্ষ থেকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং অব ১.৫ ডিগ্রি শিরোনামে ৭২৮ পৃষ্ঠার বিশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার জন্য খুব বেশি সময় হাতে নেই। গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে উষ্ণতা বৃদ্ধির হার শিল্প বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের সাপেক্ষে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার ২০১০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি, শিল্প, ভবন, পরিবহন ও শহরগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।
বিশ্ব এখনও গড়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে উষ্ণ হচ্ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির এ হার যেন স্থিতিশীল থাকে, তা নিশ্চিত করতে আগামী কয়েক বছরে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা।
মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষক অ্যান্ড্রু কিং এক বিবৃতিতে বলেন, এটা উদ্বেগের, কারণ আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে অনেক সমস্যা হবে। বিশ্বের অনেক জায়গায় তাপদাহ দেখা দেবে, উত্তপ্ত গ্রীষ্ম দেখা যাবে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং ভয়াবহ খরা ও ভারী বর্ষণ হবে।
কিং বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার সুযোগ ক্রমাগত শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো কার্বন নির্গতকরণের হার যে মাত্রায় কমানোর অঙ্গীকার করেছেন, তাতে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হওয়ার নয়।
করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানী নাতালি মাহোওয়াল্ড আইপিসিসির প্রতিবেদনটির নেতৃত্বস্থানীয় লেখক। তিনি বলেন, ‘কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে এটি জীবন-মৃত্যুর পরিস্থিতি’।
তবুও আইপিসিসি-র গবেষকরা হতাশ হতে নারাজ। রবিবার গবেষক মাহোওয়াল্ড বলেন, ‘আমাদের সামনে এখন অনেক বড় কাজ। কিন্তু এটা করা অসম্ভব নয়। আগামীর বিশ্বকে আমরা কিভাবে দেখতে চাই সে সিদ্ধান্তটা এখন আমাদের হাতে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, উষ্ণতা বৃদ্ধির হার সীমিত রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে ও নজিরবিহীন পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। তবে বিশ্বনেতারা যদি এখন থেকে কোনওভাবে ভবিষ্যত মানব-সৃষ্ট উষ্ণতাকে আধা ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করতে পারেন, তবে বিশ্বের আবহাওয়া, স্বাস্থ্য ও বাস্তুব্যবস্থা ইতিবাচক অবস্থার দিকে যাবে।
পানি সংকটে থাকা মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। কমে যাবে উষ্ণতা ও কুয়াশা এবং সংক্রামক রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় চার ইঞ্চি হ্রাস পাবে।
মেরুদণ্ডী প্রাণি ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার পরিমাণ কমে অর্ধেকে নেমে আসবে। তাপদাহ, প্রবল বর্ষণ ও খরার প্রচণ্ডতা কমে যাবে। বিশ্বের বেশিরভাগ প্রবাল প্রাচীরকে রক্ষা করা যাবে, ঠেকানো যাবে পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার বরফ খণ্ডে অনিবার্য গলন।
আইপিসিসির প্রতিবেদন বলছে, ২০৫০ সালের মধে বাংলাদেশেও উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। মিঠাপানির মাছ চাষের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো বিপাকে পড়বেন। জায়গার অভাব ও স্থানীয় ব্যবস্থায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় তাদের অন্যত্র সরে যাওয়াও কঠিন।
উন্নয়নশীল দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো (সিডস) সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। মূলত অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর ও বাস্তুচ্যুত হওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার সীমাবদ্ধতার কারণে চ্যালেঞ্জ বেশি থাকবে। প্রতি ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সামুদ্রিক মাছ চাষের শিল্প ৩০ লাখ মেট্রিক টন কম মাছ পেতে পারে। আর এর প্রভাব বেশি পড়বে আর্কটিক ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।
সূত্র: কালের কন্ঠ