শুক্রবার, ১২ই অক্টোবর, ২০১৮ ইং ২৭শে আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

দরকারি উপকারী অথচ অবৈধ যানবাহন, কে দেখবে এসব?

ডেস্ক রিপোর্ট : কারওয়ান বাজারের পেট্রো বাংলার সামনে হাতিরঝিলের রাস্তায় বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে। একটির সামনে দাঁড়ানো এক যুবক যাত্রী ডাকছে- ‘মেরুল-বাড্ডা, রামপুরা ব্রিজ ২৫ টাকা…। মিনিট দশেকের মধ্যে গাড়িটির সব কটি আসন ভরে গেল। ড্রাইভারের সঙ্গে বসলো দুজন, পেছনে বসলো ১২ জন। এবার চলে গেল মাইক্রোবাসটি। ফাঁকা স্থানে এসে দাঁড়াল আরেকটি মাইক্রোবাস।

যাত্রীবেশে একটি গাড়িতে চড়ে কারওয়ান বাজার থেকে রামপুরা টিভি সেন্টার পর্যন্ত গিয়ে গাড়িগুলোর যে অবস্থা তাতে দেখা যায়, গাড়ির ভেতরে প্রায় প্রতিটি আসন ভাঙা। কোনোরকম বসা যায়। ড্রাইভারের সিটের ডান দিকের দরজাটি রশি দিয়ে বাঁধা। ভেতরে তিন জনের সিটে ৪ জন, ইঞ্জিনের ওপর সিট না থাকলেও সেখানে সিট বানিয়ে ৩ জনের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গাড়ির সামনে ড্রাইভারসহ ২ জন্য বসার ব্যবস্থা থাকলেও ৩ জন বসেছেন। গাড়ির জানালাগুলোর কাচ খোলা যায় না ফলে ভেতরে কোনও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় রীতিমত সবাই ঘেমে অস্থির। তার ভেতরেই গাদাগাদি করে মানুষ যাচ্ছে কারওয়ান বাজার থেকে রামপুরা ব্রিজ। ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। হঠাৎ দেখা গেল চলন্ত অবস্থায় রাস্তার মাঝে ভেতরের দরজার লক কাজ না করায় কন্ডাক্টর তা খুলে রেখেছে। দরজা খোলা অবস্থাতেই ছুটে চলছে গাড়ি। ফিরতি গাড়িগুলো একইভাবে রামপুরা থেকে যাত্রী তুলে আনছে কারওয়ান বাজার।

মূলত হাতিরঝিলের রাস্তায় এভাবে ভাড়ায় যানবাহন চালানোর অনুমতি নেই। তারপরও এসব মাইক্রোবাস চলছে। ঝিলের রাস্তায় পুলিশের চেকপোস্ট আছে কিন্তু অজানা কারণে তারা কিছু বলে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এসব যানবাহন রাস্তায় নামিয়েছে। প্রথমে দুই-চারটি গাড়ি থাকলেও এখন অবৈধভাবে এ রুটে চলছে শতাধিক মাইক্রোবাস। রামপুরার বাসিন্দা মোহাম্মদ মাসুদ এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রক।

কারা এসব মাইক্রোবাস নামিয়েছে জানতে চাইলে কয়েকজন মাইক্রোবাসের চালক বলেন, হাতিরঝিল চালুর পর ২০১৩ থেকে এই গাড়ি চলছে। প্রথমে কারওয়ান বাজারের কিছু চালক এটা শুরু করেছিলেন। তখন মাইক্রোবাসগুলো অনেক ভালো মানের ছিল। ধীরে ধীরে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যায়। পরে এই ভাঙাচুরা গাড়িগুলো এসে যোগ দেয়। আর এসব গাড়ি ‘লাইনম্যান’ ঠিক করে দেন।

এই চালকরা আরও বলেন, ‘কারওয়ান বাজারের পেট্রো বাংলার সামনের অংশে অবৈধভাবে পার্ক করা হয় এসব মাইক্রোবাস। গড়ে ১৩-১৪ জন যাত্রী আনা-নেয়ায় প্রতি ট্রিপে গাড়িচালকের আয় ৭০০ টাকা। এ আয়ের অংশ থেকে প্রতিদিন ১৫০০ টাকা ভাগ করে দিতে হয় হাতিরঝিল প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৬টি থানার পুলিশ যেমন- তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, রমনা ও হাতিরঝিল থানা। এছাড়া ট্র্যাফিক পুলিশসহ চারজন ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টর, লালপুলিশ (হাতিরঝিল নিরাপত্তাকর্মী), শ্রমিক লীগ, যুবলীগের নামে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নেতাদেরও এই টাকার ভাগ দিতে হয়। এ গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ ও মাসোয়ারা তোলেন জামাল।

তারা আরও বলেন, মাইক্রোবাস দিয়ে ব্যবসা করতে হলে নতুন গাড়ি লাগে না। আড়াই লাখ টাকা দিয়ে পুরাণ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি কিনলেই চলে। পরে ২০ হাজার টাকা দিয়া শ্রমিক সমিতির রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়। মাইক্রোবাসের মালিক নিজে গাড়ি চালালে প্রতিদিন ১৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে। আর চালক ভাড়ায় নিলে অতিরিক্ত ১২০০ টাকা বেতন দিতে হবে। কারওয়ান বাজার থেকে রামপুরা পর্যন্ত যাত্রী ভাড়া ২৫ টাকা। মাসুদের লোকজন এসব টাকা নেন। মাইক্রোবাসের পাশাপাশি একই ধরনের কিছু প্রাইভেটকারও চলাচল করে বলে জানান তারা।
খোঁজ নিয়ে মাসুদের নম্বরে ফোন দেয়ার পর পরিচয় জেনে তিনি ফোন বন্ধ করে দেন। পরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

নিয়মিত চলাচল করেন এমন বেশ কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই যানবাহনের অনেক চাহিদা। এই বাহনটি অনেক উপকারী এবং খুবই দরকারি অথচ এই জায়গাটায় সরকারের কোনও মনোযোগ নেই বললেই চলে। শরীফ নামের একজন যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী কোন রুটে কী ধরনের যানবাহন দরকার সেই হিসাব সরকারের নেই। যেখানে সিটিবাস দরকার সেখানে দিয়ে রেখেছেন চক্রাকার ট্যুরিস্ট বাস! হাতিরঝিলের এই রাস্তা যখন ছিল না তখন এই যাত্রীরা মহাখালী বা মৌচাক হয়ে ওই পারে যেত, আর এখন দিয়ে রেখেছেন এই ভাঙা গাড়ি। দেখেন আমরা কত কষ্ট করে যাই। ঠিকমতো বসতে পারি না। সাধারণত যে মাইক্রোবাসে ৭ জন বসেন সেখানে আমরা ১৩-১৪ জন গাদাগাদি করে বসি। তবে এগুলোকে বিশেষ মাইক্রোবাস বলা উচিত। কারণ বসার সিটগুলো এমনভাবে সেট করা যাতে ১৪ জন বসতে পারে। এটা না দেখলে বুঝানো যাবে না।

আরেক জন যাত্রী বললেন, কষ্ট সহ্য করে এই সিটে বসে প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক লোক যাতায়াত করেন। এই লাইনে যদি সিটি বাসের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে অবৈধ চাঁদাবাজির জন্ম হতো না। মূলত চাঁদাবাজির এই কাচা পয়সার জন্যই এই যানগুলো বৈধতা পায় না। নয়তো ভালো মাইক্রোবাস দিয়ে বৈধতা দিলেই-বা সমস্যা কী?

তবে হাতিরঝিলে দীর্ঘদিন এভাবে প্রকাশ্যে রুট পারমিট ছাড়া মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার চলাচল করলেও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নাকি কিছুই জানেন না। এ বিষয়ে বিআরটিএ’র পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নুর মোহাম্মদ মজুমদার আরটিভি অনলাইনকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। বিআরটিএ রুট পারমিট ছাড়া কোনও গাড়ি চলাচল করতে পারবে না। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ডিএমপি ট্র্যাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, হাতিরঝিলে ফিটনেস ও রুটপারমিট ছাড়া যান চলাচলের বিষয়ে আমি খোঁজ নেব। এসব বিষয়ে কোনও ছাড় দেয়া হবে না। আরটিভি অনলাইন