শ্রীমর্দ্দির বাঁশির গ্রাম : মেলায় আশায় স্বপ্ন বুঁনছেন হতদরিদ্র কারিগররা
ফয়সল আহমেদ খান,শ্রীমর্দ্দি (হোমনা,কুমিল্লা) থেকে : কুমিল্লার ছোট্র গ্রাম শ্রীমর্দ্দি।শ্রীমর্দ্দি গ্রামটিকে মানুষের কাছে সুপরিচিত কেবল বাঁশির গ্রাম হিসেবে।গ্রামটি বসবাস করেন প্রায় ৫০টি বাশির কারিগরদের পরিবার।তারা চৌদ্দ পুরুষ ধরে কেবল বাঁশি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে কথা বলে জানা গেছে।বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে,বাংলাদেশের মোট তৈরীকৃত বাঁশির ৭০ ভাগ বাঁশি তৈরী হয় এই শ্রীমর্দ্দি গ্রামে।গ্রামটির বাঁশি তৈরির ঐতিহ্য এক’শ থেকে সোয়া’শ বছরের। পরম্পরা ধরে রেখে পূর্বপুরুষদের সৃষ্টিশীল কাজটি এখনো চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ। শুধু টিকে থাকাই নয়, কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমর্দ্দী গ্রামের কারুশিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি বাঁশি যাচ্ছে দেশের বাইরেও।
বাঁশি কারিগরা জানান,রাত পোহালেই (শনিবার) বৈশাখী মেলা।মেলায় তারা আশা করছেন তাদের তৈরী প্রায় ৩ থেকে ৫ কোটি টাকার বাঁশি সারা দেশে বিক্রি হবে।যদি না কোন দূর্বিপাক না হয়।সে বিক্রির আশায় তারা নতুন স্বপ্ন বুনছেন।আশা করছেন সারা বছর যে ধারদেনা আর বিভিন্ন এনজিওও মহাজন থেকে মোটা সুদে ঋণ এনে বাঁশির কাচামাল কিনে বাঁশি বানিয়ে দেশ-দেশান্তরে পাঠিয়েছেন বিভিন্ন ব্যাবয়াসী ও পাইকারদের মাধ্যমে কালকের লাভের মধ্য দিয়ে পুজিসহ লাভ উঠে আসবে।
কথা হয় গ্রামটির বেশ কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, এক শ থেকে সোয়া শ বছর আগে গ্রামের কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু প্রথম বাঁশি তৈরি করেন। বর্তমানে ভারতের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ছিল তাঁদের। সেখান থেকে দেখে এসে বাঁশি তৈরি শুরু করেন তাঁরা। প্রথমদিকে অল্প কিছুসংখ্যক বাঁশি তৈরি করে নিজেরাই ফেরি করে বিক্রি করতেন। দুজনই চমৎকার বাঁশি বাজাতেও পারতেন। তাঁদের কাছ থেকে অন্যরা এ কাজ শেখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে কোকিল দাস ও দীনবন্ধু সপরিবারে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যান।
গতকাল সরেজমিনে শ্রীমর্দ্দীতে বাঁশির গ্রামের অনিল দাসের বাড়ীতে দেখা গেলো, বাড়ির নারী পুরুষ ও ঘড়ে বৌ-ঝি সব্বাই মিলে বাশিতে রং করছেন।মিলেমিশে বাঁশি তৈরির ছোটবড় সবাই। কেউ ছোট ছোট করে মুলি (বাঁশ) কাটছেন। কেউ সিক দিয়ে ছিদ্র করছেন, কেউ আগুনের ছেঁকা দিয়ে বাঁশির গায়ে নকশা করছেন। কেউবা নকশা ফুটিয়ে তুলছেন রংতুলিতে।
বাঁশিতে রং করছিলেন গৃহবধূ মৌসুমী,৯ম শ্রেনীর ছাত্রী। তিনি জানালেন, বাঁশি তৈরি ও বিক্রি করেই সংসার চলে। তবে শুধু জীবিকার জন্যই নয়, মনের টান থেকেও এই কাজ করেন তাঁরা।
পুরনো কারিগর জয়নাল জানালেন, শ্রীমর্দ্দীর অন্তত ৫০টি পরিবার বাঁশিশিল্পে যুক্ত। পরিবারের সব বয়সের নারী, পুরুষ, শিশু সবাই কোনো না কোনো ধাপে বাঁশি তৈরিতে হাত লাগান।
বাঁশির গ্রামে ঘুরে দেখা গেলো তারা নানা ধরনের বাঁশি তৈরি করেন শ্রীমর্দ্দীর মানুষেরা।অনিল,সুনীল,যতীন ৩ ভাই সবাই জানালেন, তাঁরা তোতা (মুখ) বাঁশি, মোহন বাঁশি, আঁড় বাঁশি,লাভ বাশি, খানদানি বাঁশি, ক্লাসিক্যাল বাঁশি, বিন বাঁশি ও বেলুন বাঁশি তৈরি করেন। তাঁদের তৈরি বাঁশি দেশের বাজার ছাড়াও ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, স্পেন, ইতালিসহ বেশ কয়েকটি দেশে যায়। যতীন্দ্র বলেন, ‘বিদেশে মুখ বাঁশির কদর বেশি। এই বাঁশি একেবারেই প্রাকৃতিক। কোনো রং থাকে না তাতে। আর দেশে চাহিদা বেশি খানদানি বাঁশির।’ তিনি আরো জানালেন, ঢাকার কিছু ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে বাঁশির অর্ডার নিয়ে তা তৈরির জন্য তাঁদের নমুনা সরবরাহ করেন। তাঁরা নমুনামতো তৈরি করে দেন। সরকারি সহযোগিতা পেলে বাঁশি ব্যাপকভাবে বিদেশে পাঠানো সম্ভব বলে মনে করেন যতীন্দ্র।
সুনীল বিশ্বাসে স্ত্রী ঝর্ণা বিশ্বাস জানান,একটি বাঁশি তৈরিতে ১৩ থেকে ১৪টি ধাপ থাকে। এটি মূলত মুলি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়। ১৩ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় বাঁশিগুলো।
নারায়নগঞ্জ জেলার নিতাইগঞ্জের ৩ জন পাইকার বসে ছিলেন বড় কার্টুন নিয়ে।কখন বাশি কাটুনে ভরবেন।তিনি মোট ৫ শ্রেনীর ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকার বাশিঁ কিনেছেন।পিকআপে করে সেগুলো নিয়ে যেয়ে প্রয়োজনে আবারো ক্ষেপ দিবেন শ্রীমর্দ্দিতে।মুন্সিগনজের বিক্রমপুরের ব্যবসায়ী দীনবন্ধু,রাজশাহীর সফিউল্লাহ সবাই অধীর আগ্রহে ভরে বাঁশি পাইকারী কিনে তা মেলায় বিক্রির আশায় মালামালা আনলোড করতে দেখা গেলো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের পাইকার রহিম মিয়া বলেন, ‘৪৫ বছর ধইরা শ্রীমর্দ্দী থেকে বাঁশি কিনা নিয়া বিক্রি করতাছি। যুবকেরাই বাঁশির আসল কাস্টমার। বাচ্চারাও কিনে। এমনও দিন গেছে, মেলায় এক দিনে এক হাজার বাঁশি বিক্রি করা যাইত। অহন বিক্রি কইমা গেছে।’
বাঁশির কারিগর চৈতন্য দাস জানান-‘একেক বাঁশির একেক দাম।একটি বাঁশি কিনতে পাইকারি (হিসেবে) সাড়ে তিন টাকা থেকে ৫ শ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয় ১০ টাকা থেকে কয়েক শ টাকায়।
সুরের কারিগরদের সবাই একবাক্যে একমত জানালেন,সরকার যদি তাদের সহজ শর্তে ব্যাংক লোন দিতো, তবে তাদের মোটা সুদে মহজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলতে হয় না।আমাদের এটা তো শিল্প।অথচ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দপ্তর তাদের কোন দিন কেউ খবরটি পর্যন্ত নেয়নি।আমরা না পারছি চৌদ্দ পুরুষের পেশা ছাড়তে ,না পারছি টিকে থাকতে।এ বিষয়ে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষন করে সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের দিয়ে সহায়তা করতে আহবান জানান হোমনার শ্রীমর্দ্দির বাঁশির কারিগররা।