বিয়ের আগেই ব্যবস্থা নিন সন্তানকে থ্যালাসিমিয়া থেকে বাঁচাতে
নিউজ ডেস্ক।। থ্যালাসিমিয়া রক্তস্বল্পতাজনিত একটি রোগ। মরণব্যাধি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার শিশু জন্ম গ্রহণ করছে। একটি শিশু পৃথিবীতে আসার পর যে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায়, থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত শিশুর মধ্যে সেটা দেখা যায় না। বিষন্নতার চাদরে ঢাকা যেন এক প্রাণ। এমন শিশুকে নিয়ে মা বাবার স্বপ্ন ভালবাসা আবেগ যেন মুহুর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। একটু সচেতন হলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো সম্ভব। থ্যালাসিমিয়ার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সারাজীবনই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা হচ্ছে ‘ব্যোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন’ ও জীন থ্যারাপি। এমন চিকিৎসা সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই একটু সচেতন হলেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
থ্যালাসিমিয়া কি? : থ্যালাসিমিয়া রক্তস্বল্পতাজনিত একটি বংশগত রোগ। থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরে রক্তের লৌহিত কণিকা পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না। ফলে এদের মারাত্মক রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। থ্যালাসিমিয়া রোগীদের প্রতি মাসে ১-২ ব্যাগ রক্ত গ্রহণ করতে হয়। এই রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে তারা বেঁচে থাকে। আবার এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসা করা না হলে রক্তশুন্যতার কারণে মারা যায়।
বাংলাদেশে থ্যালাসিমিয়া রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান এই রোগ প্রতিরোধে কাজ করছে। তন্মধ্যে থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অন্যতম। রাজধানীর চামেলিবাগে অবস্থিত হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় দূর-দূরান্ত থেকে অনেক রোগী এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হৃদয়কাড়া, ফুটফুটে অনেকগুলো শিশু শুয়ে আছে হাসপাতালের বেড়ে। তাদের দিকে তাকালে যে কারো মায়া হবে।
কুমিল্লা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আসমা আক্তার নিপা নামে এক মা শুকনো মুখে বসে আছেন তার ফুটফুটে সন্তান আরাফাতের পাশে। কবে থেকে বুঝতে পারলেন আপনার শিশু এই রোগে আক্রান্ত? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওর বয়স যখন ৫ মাস তখন বুঝতে পারি যে তার থ্যালাসিমিয়া হয়েছে। প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি। ওর সব সময় ঠান্ডা লেগে থাকতো। হাত পা হলুদ হয়ে যায়। ফলে কুমিল্লায় কয়েকজন ডাক্তার দেখাই। তারা আমাদেরকে পরে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। পরিক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারি তার মধ্যে এই রোগ আছে।’
‘এখন তার বয়স চলছে ২ বছর ৮ মাস। প্রতি দুই মাস পর পর এখানে এসে তাকে রক্ত দিতে হয়। যখন রক্ত কমে যায় তখন ওর খাওয়া, খেলা-ধুলা, হাঁটা-চলা সবকিছু কমে যায়।’ বললেন আসমা আক্তার নিপা।
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. মো. আবদুর রহিম এর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই হাসপাতালে প্রায় আড়াই হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। সারা দেশ থেকেই রোগীরা আসে। থ্যালাসিমিয়াকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই রোগকে প্রতিরোধ করা যায়। এ জন্য আমরা বলে থাকি বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার কথা। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসিমিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সবাই এ ব্যাপারে সচেতন হলে খুব সহজে থ্যালাসিমিয়া প্রতিরোধ করা যাবে।’
‘বাংলাদেশে ১ কোটি ১০ লাখ লোক অজ্ঞাতসারে থ্যালাসিমিয়া রোগের বাহক। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার শিশু থ্যালাসিমিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। বাংলাদেশে থ্যালাসিমিয়া রোগে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০।’ বললেন তিনি।
থ্যালাসিমিয়া কিভাবে হয়? : মানব কোষে রক্ত তৈরি করার জন্য ২টি জিন থাকে। কোনো ব্যক্তির রক্ত তৈরির একটি জিনে ত্রুটি থাকলে তাকে থ্যালাসিমিয়া বাহক বলে। আর যদি দুইটি জিনেই ত্রুটি থাকে তাহলে তাকে থ্যালাসিমিয়া রোগী বলে।
একজন থ্যালাসিমিয়া বাহক যদি অপর একজন বাহককে বিয়ে করে তাহলে তাদের প্রতিটি সন্তানের থ্যালাসিমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ। এ ধরনের পরিবারে একাধিক সন্তান থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত হওয়ার নজির রয়েছে। তবে রক্তের গ্রুপের সঙ্গে থ্যালাসিমিয়া রোগ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করালে এ সমস্যা বহুলাংশে কমে যায়।
থ্যালাসিমিয়া রোগের লক্ষণ : এ রোগের লক্ষণ সাধারণত তিন মাস বয়স থেকে দেখা দেয়। শিশু জন্মের ১ থেকে ২ বছরের মধ্যে থ্যালাসিমিয়া রোগ ধরা পড়ে। এই রোগের কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন-ফ্যাকাশে হয়ে পড়া, ক্ষুদামন্দা দেখা দেওয়া, খাবার পরে বমি হওয়া, ঘন ঘন ইনফেকশন, জন্ডিস, খিটখিটে মেজাজ, রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৩-৫ গ্রাম বা ডেসিলিটারে নেমে আসা। এদের প্রায়ই জীবাণু সংক্রমনের জন্য সর্দি, কাশি ও জ্বরে ভোগেন। এক কথায় বলা যায়, রোগী যদি ফ্যাকাশে বা হলদে হয়ে যায়, বয়সের তুলনায় তাকে কৃষ বা ছোট দেখায়, পেট বড় দেখায় তাহলে এ রোগ আছে বলে সন্দেহ করা হয়।
থ্যালাসিমিয়ার চিকিৎসা কি নেই? : থ্যালাসিমিয়া রোগের চিকিৎসা রয়েছে। তবে এর চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। রক্তশূন্যতা পূরণের জন্য রোগীদের প্রতি মাসে ১-২ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। এছাড়া এদের শরীর থেকে ক্ষতিকর লৌহ বের করার জন্য নানা ধরনের ঔষধ খেতে হয়। একটি শিশুর চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
এ প্রসঙ্গে ডা. আবদুর রহিম বলেন, ‘থ্যালাসিমিয়ার চিকিৎসা রয়েছে। তবে এটি ব্যয়বহুল। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে ভাই-বোনের মধ্যে ম্যাচিং থাকতে হবে। এর চিকিৎসা খরচ প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা লাগে। তবে আমাদের দেশে প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা এখনো শুরু হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ চালু করার চেষ্টা করছে।’
থ্যালাসিমিয়া থেকে বাঁচার কি কোনো উপায় আছে? : ডা. রহিম বলেন, ‘‘থ্যালাসিমিয়া নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শরীরে রক্ত কম হওয়া ছাড়া এদের আর কোনো সমস্যা নেই। তারা সব কিছু করতে পারবে। খেলা-ধুলা পড়ালেখা থেকে সবকিছু। আমাদের এখানকার অনেক রোগী আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। ব্যাংকে চাকরি করছে।’’
‘‘ যদি কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয় তারা সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় না। তারা আস্তে আস্তে প্যারালাইজড রোগীদের মতো হয়ে যায়। এভাবে দশ বছর পর্যন্ত বাঁচার সম্ভাবনা থাকে। অন্য দিকে চিকিৎসা নিলে ৫০ থেকে ৬০ বছর বাঁচতে পারে।’’ বললেন ডা. রহিম
তার ভাষ্য ‘‘এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে,নাকি আমাদের সহযোগিতায় সমাজের সক্রিয় একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকবে। অন্যথায় তারা বোঝা বা প্রতিবন্ধিদের মতো হয়ে থাকবে। তাই আমরা চেষ্টা করছি তারা যেন সমাজের জন্য বোঝা না হয়।’’ বললেন তিনি।
থ্যালাসিমিয়ায় আক্রান্তদের অনেক পরিবার আছে যাদের পক্ষে সন্তানের ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয় না। পারিবারিক আয় কম হওয়ায় সন্তান নিয়ে অনেকে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। এই রোগে আক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে কি করবেন তা ভেবে কোনো কূল পাচ্ছেন না। অসহায় এসব রোগীদের বাঁচাতে, সমাজের জন্য যাতে তারা বোঝা হয়ে না যায় সে জন্য থ্যালাসিমিয়া ফাইন্ডেশন যাকাত সংগ্রহ করে তাদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে।
এ সম্পর্কে ডা. রহিম বলেন, ‘আমাদের এখানে ডে কেয়ার পদ্ধতিতে চিকিৎসা চলছে। দৈনিক ২০ থেকে ৫০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। দিনে দিনে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। যেটা অন্য হাসপাতালের পক্ষে সম্ভব হয় না। ঢাকার বাহিরে থেকে সকালে এসে বিকালে চিকিৎসা নিয়ে চলে যেতে পারে। তবে অনেক রোগীর আর্থিক অবস্থা ভালো না। কারো মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার চেয়েও কম। ফলে তারা সন্তানের চিকিৎসা করাবে নাকি পরিবার চালাবে। তাদের এমন অসহায় করুণ অবস্থা দেখে আমরা রোগীর চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য যাকাত সংগ্রহ করছি।’
তার মতে ‘‘থ্যালাসিমিয়া আক্রান্তদের সঠিকভাবে চিকিৎসা দিলে তাদের কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। কিন্তু আর্থিক সংকটে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেনা। চিকিৎসা না করালে সেটা দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। দেশে অক্ষম লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে। হয়ে ওঠবে বোঝা হিসেবে। তাই কোমলমতি এসব শিশুদের সহযোগিতায় সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।’’ উৎস : একুশে টেলিভিশন