১৩ বছর পর দেখা হবে বাবা-মেয়ের
ডেস্ক রিপোর্ট: ১৩ বছর পর আদরের সন্তানের মুখটা দেখে আর সইতে পারলেন না সাত্তার। ’মা রে” বলে সেন্স হারিয়ে ফেললেন। লোকটা জ্ঞান হারালো ঠিকই,কিন্তু চাঁদপুর পুলিশ সুপারের রুমে তখন বইছে আনন্দের বন্যা। কারও কারও চোখের ধার বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল আনন্দাশ্রু। কি প্রশান্তি! কি তৃপ্তি!
বিষয়টা খুবই সাধারণ। তবে এখন আর সাধারণ নেই। এক যুগ পর খোয়া যাওয়া সন্তানের মুখ দেখতে পেলে ঘটনাটা আর সাধারণ থাকে কি করে বলুন? মেয়েটার নাম নার্গিস আক্তার। ৯ বছরের ফুটফুটে সুন্দর এটকা বাচ্চা মেয়ে। তাই বাড়ির সবাই আদর করে মনি বলে ডাকে। দুরন্ত আর উচ্ছল মনির দিনগুলো ভালই কাটছিল বাবা মার সাথে। বাবা হত দরিদ্র কৃষক। কিন্তু পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই। অগত্যা প্রতিবেশী স্বজনের দারস্থ হতে হলো তাকে। তারা ধনাঢ্য পরিবার। প্রায় সারা বছর ঢাকাতেই থাকেন।তাদের বাসায় গেলে খাওয়া পরার অভাব হবে না। ধনাঢ্য এই পরিবারও আশ্বাস দিল, বাসাই তেমন কাজই নেই। খাবে-দাবে টিভি দেখবে আর মাঝে মাঝে গৃহকর্ত্রীকে সাহায্য করবে। বিনিময়ে মাস গেলে ভাল মাইনা পাবে।
বউয়ের সাথে পরামর্শ করে মনিকে পাঠালো ঢাকায় সাত্তার। যাওয়ার সময় বাবার গলা ধরে খুব কেঁদেছিল মনি। মায়ের আচঁলটা জাপটে ধরে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদায় নিয়েছিল ঠিকই। মা বলেছিল সামনের মাসেই দেখা হবে আবার। বিশ্বাসও করেছিল মেয়েটা। কিন্তু তার বিশ্বাস সত্যি হয়নি। ঢাকার বাসায় আনার পর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। সইতে না পেরে মাস খানেক পরেই রাতের আধারে পালিয়ে চলে যায় সদরঘাট। ৮/৯ বছরের বাচ্চাকে একা একা ঘুরতে দেখে এগিয়ে আসে এক লোক।
বলে ‘আমার সাথে যাবে।’ এরপর ঐ লোকটি মনিকে নিয়ে যায় উত্তরায় তার চাচীর বাসায়। এক মাস পরেই ঢাকা থেকে তার মনিব বাগেরহাটে পাঠিয়ে দেয় তার মেয়ের কাছে। ৮ বছর কাজ করে ঐ বাসাতে, তবে সেখানেও তার ওপর চলে নির্যাতন। আবার পালায় মনি। কিন্তু কোথায় যাবে, কি করবে বুঝতে পারে না। আবারো অসহায়ের মতো ঘুরতে থাকে পথে পথে। এবার আশ্রয় হয় এক কমিশনারের বাড়িতে। কিছুদিন পরেই কমিশনার মনিকে পাঠায় তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট হলেও বর্তমানে ঢাকায় সেটেল্ড। বাড়ির কর্ত্রী অমায়িক মানুষ। মাঝে মাঝেই গল্প করেন মনির সাথে। সদা উচ্ছল মেয়েটা মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে যায়। একদিন কথাচ্ছলে মনি জানায় তার করুন ইতিহাস। শুনে খুব মায়া হয় তার। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কেননা মনির ছোট বেলার কথা কিছুই মনে ছিল না। শুধু বলতে পারে চাঁদপুরের দিকে কোথাও হরিনহাটা জাতীয় নামের একটা গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। বাবার নাম সাত্তার। যাই হোক এইটুকু সম্বল নিয়ে কারও এক যুগ আগের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না।
হঠাৎ একদিন গৃহকর্ত্রীর আলাপ হয় চাঁদপুরের পুলিশ সুপারের সাথে। কথা প্রসঙ্গে মনির কথা উঠে আসে। ঘটনাটা দুঃখ প্রকাশ আর সান্তনার মধ্য দিয়েই শেষ হতে পারতো। কিন্তু পুলিশ সুপার মহোদয় বাসায় এসে ঘুমোতে পারেন নি। যতবার তার আদরের মেয়ে তাকে বাবা বলে ডেকেছে, ততবারই তার মনে হয়েছে কেউ হয়তো প্রতিক্ষা করছে মনির বাবা ডাক শোনার জন্য।
স্থির করলেন খুঁজবেন ।inspector investigation চাঁদপুর মডেল থানা মাহবুব সন্ধান শুরু করেন। সন্ধান মেলে হরিণঘাটের তারপর ঐ এলাকার সাবেক মেম্বার হাসানের সহায়তায় সন্ধান মেলে ১২জন সাত্তারের। তবে দুঃখের বিষয় মনির বাবা সাত্তারের সন্ধান কেউ দিতে পারে না। হাল ছাড়েন না পুলিশ সুপার। গত ১০-১২ বছরে কোন কোন সাত্তার মারা গেছেন, কারা গ্রাম ছেড়েছেন তাদের খোজ নেওয়া চলে।
অবশেষে জানা যায়, মূল গ্রাম থেকে বসতি ছেড়ে চর এলাকায় বসতি করেছে এক সাত্তার। ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখ এসপি অফিসে আনা হয় তাকে। কথা শুনে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এরপর একটা ভিডিও কল। এক প্রান্তে পুলিশ সুপার মহোদয় অন্য প্রান্তে মনি। কথার এক পর্যায়ে ফোনের ক্যামেরা তাক করা হয় সত্তারের দিকে। এরপর স্তব্ধ সবাই।
ফোনের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় দুটি মানুষ। জড়িয়ে ধরতে চায়। কাঁদতে চায় এক যুগের জমা হওয়া কান্না। একটুও ভূল হয়নি দু’জনার। এক যুগ ভূলতে দেয়নি পরস্পরের মুখ। যে ছবি থাকে হৃদয়ে, সময় তাকে কি মুছে দিতে পারে?
আজ ঢাকা থেকে আনা হবে মনিকে। ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার বাবা, ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার ঠিকানা। শুধু থাকছে না তার মা। মেয়ের শোকে ৮বছর আগে গত হয়েছেন তিনি। মনিকে কি পারবে বাবার বুকে ফিরে মায়ের অভাব ভূলতে? বাবাইবা কিভাবে সামলাবেন আজকের এই ২২ বছরের কন্যাকে।
এখন এত ভাবার সময় নেই। চাঁদপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আসছে মনি। নিভে যাওয়া দীপ আবারও জ্বলতে চলেছে । মিলন মেলার চলছে আয়োজন। এই মিলনক্ষনে আপনিও আমন্ত্রিত। শেষ কথা নিরাপদ হোক সকল শিশুর শৈশব, জাগরুক থাকুক প্রাণের কলরব।
অনুলিখন : আশীষ বিন হাসান , অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেড়া সার্কেল , পাবনা।