ছোট দুই দেশ যেভাবে কাঁপালো বিশ্বকাপ ফুটবল
অনলাইন ডেস্ক: বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়া- ছোট্ট এই দুটো দেশ ফুটবল বিশ্বের বড় বড় দুটো দেশকে হারিয়ে রাশিয়ায় চলতি বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনালে উঠেছে। আর যদি তারা শেষ পর্যন্ত ফাইনালে যেতে পারে, তাহলে সেটা হবে ফুটবল বিশ্বকাপে নজিরবিহীন এক ঘটনা।
শেষ পর্যন্ত যদি বেলজিয়াম চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে আয়তনের বিচারে এই দেশটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট্ট দেশ যারা এই টুর্নামেন্ট জিতবে। বলে রাখা ভাল, বেলজিয়ামের আয়তন মাত্র ৩০,০০০ বর্গ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক।
অন্যদিকে, আরেক সেমিফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ৪১ লাখ। যদি এই দেশটি চ্যাম্পিয়ন হয় তাহলে তারা হবে উরুগুয়ের পর বিশ্বের আরেকটি কম জনসংখ্যার দেশ যারা বিশ্বকাপের ট্রফি জিতবে। উরুগুয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দু’বার- ১৯৩০ এবং সবশেষ ১৯৫০ সালে।
রাশিয়ায় এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে যে ৩২টি দেশ খেলছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হচ্ছে আইসল্যান্ড, উরুগুয়ে এবং পানামা।
সেমিফাইনালের দুটো ম্যাচ
সাধারণভাবে মনে করা হয়, কোন একটি দেশ আয়তনে যতো বড়ো হবে কিম্বা তার জনসংখ্যা যতো বেশি হবে সেদেশে ততো বেশি প্রতিভাবান ফুটবলার পাওয়া যাবে। খেলাধূলার বিভিন্ন টুর্নামেন্টেও হয়তো তাদের সাফল্যের সম্ভাবনাও হবে বেশি। এই ধারণার বড় রকমের ব্যতিক্রম অবশ্য আছে: যেমন ভারত ও চীন। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপে বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়ার মতো দুটো দেশের সাফল্য প্রচলিত এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।
অতীতে যারা যারা বিশ্বকাপ জিতেছে, উরুগুয়ে ছাড়া, তাদের রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা। যেমন ব্রাজিলের লোকসংখ্যা ২০ কোটি ৭০ লাখ, জার্মানির আট কোটি ৩০ লাখ, ফ্রান্সের ছয় কোটি ৭০ লাখ, ইটালির ছয় কোটি, ইংল্যান্ডের পাঁচ কোটি ৩০ লাখ এবং আর্জেন্টিনার চার কোটি ৩০ লাখ। বেলজিয়াম এবং ক্রোয়েশিয়া এই হিসেবকে প্রচলিত ধারণাকে এবার বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে।
বেলজিয়াম সাধারণত ‘ফুটবলের দেশের’ চাইতেও সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বেশি পরিচিত ‘চকলেট’ এবং ‘বিয়ারের দেশ’ হিসেবে। এই দেশটি এর আগেও একবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছিল, ১৯৮৬ সালে। সেবছর বেলজিয়ামের যাত্রা থামিয়ে দিয়েছিল দিয়েগো ম্যারাডোনার দল আর্জেন্টিনা।
ক্রোয়েশিয়াও এর আগে সেমিফাইনাল খেলেছে, সেটা ১৯৯৮ সালে, ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে। সে বছর ফুটবল সুপারপাওয়ার জার্মানিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে তারা সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে বলকান যুদ্ধ থেকে মাত্র বেরিয়ে আসা এমন একটি দেশের এই সাফল্য তখন সবার নজর কেড়েছিল।
কিন্তু তারা কীভাবে এটা সম্ভব করলো?
খেলাধূলার জগতে ছোট ছোট দেশের সাফল্যের কথা কিন্তু এর আগেও শোনা গেছে। এরকম একটি দেশের উদাহরণ হতে পারে বিশ্বের দ্রুততম মানব উসাইন বোল্টের দেশ জ্যামাইকা। এই দেশের জনসংখ্যা মাত্র ২১ লাখ। তবে ফুটবলের মতো খেলায় ছোট দেশ হয়ে এধরনের সাফল্য অর্জন করা একটু কঠিনই বটে। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে যে বেলজিয়াম এবং ক্রোয়েশিয়ার এই সাফল্যের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে।
ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুটো দেশের যেসব সম্পদ আছে ফুটবলের পেছনে সেসব ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারার কারণেই তারা বিশ্বকাপের এতোটা পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে। বেলজিয়ামের জন্যে এই সম্পদ হচ্ছে – অর্থ এবং খেলাধূলার জনপ্রিয়তা। বিশ্বের ২০টি ধনী দেশের তালিকায় আছে বেলজিয়াম এবং বেলজিয়ানরা খেলাধুলার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১০ সালে বেলজিয়ামে ফুটবল ক্লাবের সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার। এসব ক্লাবের সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ যা কীনা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ।
তরুণ ফুটবলার তৈরি করা:
বেলজিয়াম তার ফুটবল নিয়ে বড় ধরনের চিন্তাভাবনা শুরু করে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে। সারা দেশ থেকে তারা প্রতিভাবান ফুটবলারের খোঁজে শুরু করে নতুন পরিকল্পনা ও অভিযান। ফুটবল কর্তৃপক্ষের এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল সারাদেশে অল্পবয়সী ছেলেদের যেসব ফুটবল ক্লাব আছে সেগুলোতে প্রতিভাবান ফুটবলারদের খুঁজে বের করে তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে আরো বেশি দক্ষ করে তোলা।
এর ফলাফল এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তারা। রাশিয়ায় যেসব ফুটবলাররা খেলছে তাদেরকে বলা হচ্ছে বেলজিয়ামের ‘সোনালী প্রজন্মের’ খেলোয়াড়। তাদের মধ্যে রয়েছে এডিন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রাইনা এবং রোমেল লুকাকু।
লুকাকু, যার পিতামাতা এসেছেন গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র থেকে, তিনিও বেলজিয়ামের তরুণ প্রজন্মের কাছে খুবই জনপ্রিয়, অভিবাসী প্রজন্মের কাছে তো বটেই, বেলজিয়ানের যারাই জাতীয় দলের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তাদের কাছে তিনি একজন ‘পোস্টার বয়।”
মঙ্গলবার দলটি বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে খেলবে ফ্রান্সের সাথে। আর এই ম্যাচে বেলজিয়ামের হয়ে যারা খেলছে তাদের অনেকের পরিবারের যোগাযোগ আছে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মরক্কো, পর্তুগাল এবং কসোভোর সাথে।
বেলজিয়ামে ফুটবলের পেছনে যতো অর্থ খরচ করা হয়, ক্রোয়েশিয়ায় তার তুলনায় খুব কমই খরচ করা হয়। কিন্তু তারপরেও তারা ক্রীড়াজগতে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে।
২০১৬ সালের অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ২০৭টি দেশের মধ্যে ক্রোয়েশিয়ার অবস্থান ছিল ১৭ নম্বরে। আর স্বাগতিক ব্রাজিলের অবস্থান ছিল ১৩তম।
রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ:
ক্রীড়াজগতের জন্যে যথেষ্ঠ অর্থ খরচ না করা সত্ত্বেও ক্রোয়েশিয়ার এই সাফল্যের পেছনে কারণ কি? এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে- ইউগোস্লাভিয়ার আমলে খেলাধুলার পেছনে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল, কিছুটা হলেও তার ফল পেয়েছে ক্রোয়েশিয়া।
“ফুটবল, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল এবং ওয়াটার পোলো – এসবে আমরা খুবই উচ্চমানের প্রশিক্ষণ পাচ্ছি। আর একারণেই খেলোয়াড়দের বড় ধরনের উন্নতি হচ্ছে,” বলেছেন ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক একজন পরিচালক রোমিও জোযাক।
এছাড়াও প্রচুর সংখ্যক তরুণ খেলাধূলার জগতের সাথে জড়িত। দেশটিতে নিবন্ধিত ফুটবলারের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ। এই হার ব্রাজিলের চাইতেও বেশি। ফিফার তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিলের জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ ফুটবল খেলে থাকে।
বেলজিয়াম এবং ক্রোয়েশিয়ার আরো একটি সুবিধা হচ্ছে – এই দুটো দেশের ফুটবলাররা বিশ্বের বড়ো বড়ো ক্লাবের হয়ে খেলে থাকে।
তারকা খেলোয়াড়:
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বর্তমানে খেলছে ১১ জন বেলজিয়ান খেলোয়াড়। স্পেনিশ ফুটবল ক্লাব রেয়াল মাদ্রিদের অন্যতম তারকা লুকা মডরিচ ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলার। গত চারবারের ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপে তিনবারই শিরোপা জিতেছে রেয়াল মাদ্রিদ।
বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়া- এই দুটো দেশেরই যে ২৩ জন ফুটবলারের স্কোয়াড আছে, প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন ঘরোয়া লীগের হয়ে খেলেন। আর বাকিরা খেলেন আন্তর্জাতিক পরিসরে। বলাবাহুল্য যে রাশিয়া বিশ্বকাপে এই দুটো দলের এতোটা পথ আসার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ।সূত্র: বিবিসি বাংলা