শিশু মনে বিদ্যা ভীতি…
ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ২৫ নম্বরের একটা ভাইবা সেই বছর থেকেই যুক্ত হয়েছিলো আমাদের স্কুলে। প্রত্যেকে ক্লাসে শ্রেণি শিক্ষকের নেতৃত্বে ভাইবা বোর্ড হয়েছিলো সেবার।আমাদের বোর্ডে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন অতিথি সদস্য…
আপাঃ তোমার স্কুলের নাম কি? (আজকের ‘মিস’ কে তখন আমরা আপা-ই বলতাম)
আমিঃ আদর্শ স্কুল… (সঠিক উত্তরঃ সরকারি আদর্শ শিশু বিদ্যালয়)
আপাঃ কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
আমিঃ ওয়ানে… (শেখানো হয়েছিলোঃ প্রথম শ্রেণি)
আপাঃ তুমি বাসায় কোথায় বসে পড়ালেখা কর?
আমিঃ বিছানায় বসি পড়ি… (চেয়ার টেবিলে বসে পড়ি এইটা ছিলো প্রত্যাশিত)
আপাঃ তোমার স্কুলের বড় আপার নাম কি?
আমিঃ মাহমুদা পারভীন… (সঠিক হইলো খালেদা ইসলাম, তিনিই প্রধান শিক্ষিকা, তবে আমরা সবাই উনাকে বড় আপা নামে ডাকতাম)
আমি নিজের বড় বোনের নাম বলেছিলাম, আর আমরা ৫ ভাই বোন এই স্কুলেইই পড়েছি, তাই আপা আমাদের সবাইকে জানতেন। আমি কিন্তু পুরো নম্বর পেয়েছিলাম। বড় আপা যেহেতু ছিলেন সেই বোর্ডে, তাই খুব মজা করে আম্মাকে আমার ভাইভার ঘটনা অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন। আমি বড় হয়ে শুনেছি সেই গল্প…
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পর্যন্ত আম্মা আমাকে হলে নিয়ে যেতেন বলে অনেক বন্ধু বিশেষত বান্ধবীরা আমাকে ভীষণ বিরক্ত করতো! খোকাবাবু বলে ক্ষেপাতো, আমি ক্ষেপতাম না। কারণ আমি জানি, তিনি পরীক্ষা হলে আসবেনই। ছোট বেলায় আম্মাকে না দেখে পরীক্ষা দিতে পারতাম না, বড় আপা আমাকে কোলে নিয়ে আম্মার সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসতেন পরীক্ষার মাঝে …
ক্লাস টুয়ে পড়ি যখন তখন আম্মাকে দেখা করতে দিতেন না, তবে দেয়ালের ওপাশ থেকে আম্মার সাথে কথা বলার অনুমতি দিতেন! আমি জিজ্ঞাসা করতাম, আম্মাঃ এটা কি লিখবো? উত্তর পেলে তবেই লিখতাম…
ক্লাস তৃতে উঠলেই টিফিন নিয়ে যেতে হবে আমাদের! সে কি আনন্দ যেদিন প্রথম টিফিন বক্স নিয়ে গেলাম স্কুলে। তবে আমরা ছোট আর প্রথম দিন দীর্ঘক্ষণ স্কুলে থাকতে পারবো কি না, সেই ভাবনা থেকেই আমাদের স্কুল টিফিনের সময় ছুটি দিয়ে দিয়েছিলো। স্কুলের প্রথম টিফিন তাই বাসাতেই খেয়েছিলাম…
স্কুলে ঢুকেই আমরা খেলার জন্য অস্থির হয়ে উঠতাম! এসেমব্লির ঘণ্টা ছিলো সবচেয়ে অপ্রিয়। গোল্লাছুট, মোরাগ লড়াই, কানামাছি চলতো পাল্লা দিয়ে। স্কুলের মাঠটা তখন অনেক বড় মনে হতো। ঘামে ভেজা হয়ে সমস্বরে গাইতাম আমার সোনার বাংলা…
ক্লাস শুরু হলে থাকতাম টিফিনের প্রতীক্ষা! টিফিনের সময়টাতেও খেলতাম। এখনো চোখে ভাসে সেদিনের মধুর স্মৃতি। সময় খুব দ্রুত যাচ্ছে, সেই সাথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরাও। মফঃস্বল ছেড়ে রাজধানীতে চলে এসেছি। পৃথিবী যখন হাতেই মুঠোই, তখন স্কুলে আর মাঠের কি প্রয়োজন? বাচ্চারা এখন কার্টুন, মোবাইলে গেইম এমন কি কোথাও বেরাতে গেলে ওয়াইফাই খোঁজে…
আমার কাছে ছোট বেলার স্কুলের প্রচুর স্মৃতি এখনো সতেজ! মেয়েকে কোন স্কুলে দেবো, এই টেনশনে আমি ভীষণ আস্থির ছিলাম! খেলার একটা মাঠ থাকবে, এমন স্কুল খুঁজেছি! বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে যাবে আসবে। আশেপাশে কি হচ্ছে দেখেব, শিখবে! এই না হলে স্কুল? পাইনি…
স্কুলে ভর্তি নিয়ে যা হয় ইদানিং, যাদের বাচ্চা আছে, তারা কম বেশী সবই জানেন। ওদের স্কুলের ব্যাগ ও সিলেবাস দেখে আমার মত অনেকেই হতাশ জানি। কিন্তু আমরা একটা দুষ্টু সিস্টেমের হাতে বন্দী হয়ে গেছি। ফ্ল্যাট বাসায় স্কুল বসেছে, এখানে এসেমব্লিও হয় শুনেছি! আমার শুধু আফসোস বাড়ে…
ভোর হলো দোর খোল খুকুমনি ওঠে রে
ঐ ডাকে জুঁই-শাখে ফুল-খুকি ছোট রে
খুলি হাল তুলি পাল ঐ তরি চলল
এইবার এইবার খুকু চোখ খুলল
অলস সে নয় সে উঠে রোজ সকালে
রোজ তাই চাঁদা ভাই টিপ দেয় কপালে
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতা যখন শিশু বয়সে মুখস্ত করি তখন এর অর্থ কি বুঝতাম? বানান গুলো খুব কি জরুরী ছিলো? আমার তা মনে হয় না। ছন্দ ও সুর দিয়ে আমরা উপভোগ করেছি তখন। কখন যে মুখস্ত হয়ে গেছে বুঝতেও পারি নি…
কিছুদিন আগে আমার কেজি ক্লাসে পড়ুয়া কন্যাকে মা খুব ধমক দিচ্ছেঃ তুমি লিখছো না কেন?
আমি খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, এইসব ও লিখবে কেন? এই কবিতা তো ও এখন শুনবে আর শুনতে শুনতে মুখস্থ্য করবে মাত্র…
বউ আমার চেয়েও বেশি অবাক হয়ে জানতে চাইলো, লিখবে না কেন? সবাই লিখছে, স্কুলেও শেখায়!
আমি খুব হতাশ হয়েছি। বাচ্চাদের উপর এই চাপ দেয়াটা খুব কি দরকার? এতে আদৌ তারা কিছু শিখতে পারবে?
ভোর লিখবে ব না ভ কোন টা ব্যবহার করতে হয় তা এই বয়সেই শিখতে হবে? একটা বাচ্চা কতটুকু নিতে পারে, এটা কি বুঝেন তারা, যারা শিশুদের জন্য সিলেবাস লিখেন…
আমার মেয়ের নাম সে আগে NIBRAS লিখতো। ইদানিং সে লিখে NLBRAS! আমরা ছোট বেলায় বড় হাতের লেখা ও ছোট হাতের লেখা বলে যা শিখেছি, এতে আমরাও বিভ্রান্ত হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি আমার মেয়ে I/i/L/I এগুলো গুলিয়ে ফেলেছে। এতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। ও যখন বুঝতে ও মনে রাখতে পারবে, I আর L কোন টা তখন সে নিজেই শুধরে নেবে।
ইংরেজিতে ২৬ টা লেটার যতোটা সহজ, বাংলায় স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জণ বর্ণ ততোটা সহজ নয়। তাই, ওদের উপর এতো চাপ দেয়া অন্যায় বলে মনে হয়। আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ এখনই।
যান্ত্রিকতা আমাদের ভর করেছে। আমরা কর্পোরেট লাইফে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছি। আমাদের বাচ্চারা বড় হচ্ছে ছোট্ট একটা বাসায়। মাটির স্পর্শ ওরা পায় না! এক ফালি বারান্দায় ওরা রোদ্দুর দেখে। রাতের আকাশে টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটিল স্টার নিয়ে ঘুমুতে যায়…
এখনো স্কুল ছুটি হলে বাচ্চারা উল্লাস করে বাড়ি ফিরে। ওরা কি তবে স্কুলটাকে সত্যিই জেলখানা ভাবে? এমন কি হবার কথা ছিলো…
বিদ্যা ভীতি দূরে সরিয়ে আনন্দময় হউক শৈশব…