বেলজিয়াম তারকা লুকাকুর জীবনের অন্য গল্প
রাশিয়া বিশ্বকাপে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বেলজিয়াম। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই তারা জানান দিচ্ছেন আমরা এসেছি বিশ্বকাপ নিতেই। খেলেছেনও তেমন। আর তাই তো বিশ্বকাপের শক্ত দাবিদার রেড ডেভিলরা। অসাধারণ খেলে সেমিফাইনালের টিকিট কেটেছেন। অব্যাহত এ জয়যাত্রায় পানামা, তিউনিসিয়া, ইংল্যান্ড, জাপান এমনকি ব্রাজিলের মতো বড় দলকেও পেছনে ফেলেছেন তারা।
বেলজিয়ামের এ জয়যাত্রার অন্যতম কারিগর রোমেলু লুকাকু। তিনি রয়েছেন গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে।
২৫ বছর বয়সী দীর্ঘদেহী লুকাকু আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বেলজিয়াম নাগরিক। ২০১৭ সাল থেকে খেলছেন ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। এর আগে খেলেছেন এভারটন, চেলসির মতো স্বনামখ্যাত ক্লাবে। বেলজিয়ামের এই পোস্টার বয় বর্তমানে দর্শক জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিন্তু এই লুকাকু তৈরি হওয়ার পেছনে রয়েছে নির্মম বাস্তবতা। নাটকের থেকেও অধিক নাটকীয় জীবনের গল্প বলেছেন তিনি ‘দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’-এ। তার নিজ মুখে বলা জীবনের গল্পটা এরকম- তখন তার বয়স মাত্র ৬ বছর। মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতিতে লুকাকু স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরতেন। সামান্য রুটি এবং দুধ বরাদ্দ থাকতো তার জন্য। এর বাইরে অন্য কিছু চিন্তা পর্যন্ত করতেন না। একদিন তার মাকে দেখলেন দুধের সঙ্গে পানি মেশাচ্ছেন। তখন তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, তারা শুধু দরিদ্রই নয় তাদের পরিবার নিঃস্ব হওয়ার পথে। তবে তার মায়ের মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকতো। যেন সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। মা এক সময় পাড়ার দোকান থেকে রুটি বাকিতে কেনা শুরু করলেন। দোকানদার হয়তো আমাকে এবং ছোট ভাইকে দেখেই ৩ দিন পরে টাকা দেয়ার শর্তে রাজি হয়ে যেতেন।
তার বাবা একজন পেশাদার ফুটবলার ছিলেন। তার ক্যারিয়ার ছিল শেষের পথে। ঠিক তেমনটাই ছিল অর্থের অবস্থাও। অর্থের অভাবে কেটে দেয়া হলো ক্যাবল কানেকশন। আর তখন থেকে ফুটবল খেলা দেখাটাও বন্ধ। শুধু তাই নয়, রাতে বাসায় ফিরে দেখতেন বিদ্যুৎ নাই। এভাবে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত অন্ধকারে থাকতে হতো লুকাকুদের। সব থেকে বেশি কষ্ট হতো গোসল করার সময়, কারণ গরম পানি থাকতো না। লুকাকু বলেন, আমাদের সংসারটাকে এত হতদরিদ্র অবস্থায় কখনোই দেখিনি। তখনই আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই যে, আমাকে কিছু করতে হবে।
ফুটবল খেলোয়াড়ের মানসিক শক্তি প্রবল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লুকাকু মনে করেন, তার থেকে প্রবল মানসিক শক্তি আর কোনো খেলোয়াড়ের হয়তো নেই। একদিন স্কুল থেকে এসে দেখেন তার মা কাঁদছেন। মাকে লুকাকু বলেছিলেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। অতি দ্রুতই আমি আন্দেরলেখট ক্লাবে খেলবো। কিন্তু পেশাদার ফুটবলার হওয়ার জন্য বয়স প্রয়োজন ১৬। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৬। এই সময়টাতে আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। প্রতিটি ম্যাচ আমি ফাইনাল ম্যাচ হিসেবে নিতাম। পার্কের খেলা থেকে শুরু করে স্কুলের ম্যাচ সব আমার কাছে ফাইনাল ম্যাচ। আমি বলে কিক নিতাম শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে। কারণ আমি জানতাম এটা বাস্তব জীবনের খেলা, ভিডিও গেমস নয়।
১১ বছর বয়সে তখন তিনি খেলতেন লিয়ার্সা ইয়ুথ টিমে। তার শরীরের রং এবং দীর্ঘ দেহের কারণে বিপক্ষ দলের অভিভাবকরা লুকাকুকে মাঠে নামতে বাধা দিচ্ছিলেন। তারা প্রশ্ন করেন, বয়স কতো? কোথা থেকে এসেছি? পরিচয়পত্র কোথায়? এসব শুনে ভীষণ রাগ হতো তার। লুকাকু বলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি মানে। আমার জন্ম এন্টর্পে, আমি বেলজিয়ান।
অন্য খেলোয়াড়দের মতো আমার বাবা-মা আসতেন না। কারণ আমাদের নিজস্ব যানবাহন ছিল না। তাই আমি দূরে খেলা হলে একাই যেতাম। আমার পরিচয়পত্র দেখালে তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা শুরু করলো। তা দেখে আমার প্রচণ্ড রাগ হতো।
আমি সব সময়ই বেলজিয়ান ইতিহাসের সেরা ফুটবলার হতে চেয়েছি। এটাই ছিল আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। খেলার সময় ভাবতাম সারা ঘরে ইঁদুর ছোটাছুটি করছে আর টেলিভিশনের অভাবে চ্যাম্পিয়নস লীগ দেখতে পারছি না। অনেক অভিভাবক আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। এসব কারণে আমি প্রচণ্ড রাগ নিয়ে মাঠে নামতাম।
নিজের জন্য এক জোড়া জুতা কেনার সামর্থ্য ছিল না লুকাকুর। বাবার জুতা পায়ে ১২ বছর বয়সে ৩৪ ম্যাচে করেছিলেন ৭৬ গোল। একদিন লুকাকুর নানা ফোন করলেন কঙ্গো থেকে। তিনি খেলাধুলার খোঁজখবর নিলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, প্রতীজ্ঞা কর তুমি আমার মেয়ের খেয়াল রাখবে। লুকাকু সেদিনই প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন তার মায়ের খেয়াল রাখার ব্যাপারে। তার পাঁচ দিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন লুকাকুর নানা।
সাক্ষাৎকারের শেষে তার স্বর্গবাসী নানাকে স্মরণ করে লুকাকু বলেন, আমি তোমার কথা রেখেছি নানা। আমি তোমার মেয়েকে সুখে রেখেছি। আমাদের রুমে আর কোনো ইঁদুর নেই। আমরা এখন আর ফ্লোরে ঘুমাই না। এখন আর কেউ পরিচয়পত্র দেখতে চায় না। কারণ এখন আমাকে সবাই চেনে।