যৌন নিপীড়ন: মুখোশ খুলছেন পুরুষ?
---
অনলাইন ডেস্ক : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া ফেলে দেওয়া হ্যাশট্যাগ মি টু ক্যাম্পেইনে প্রকাশ পেয়েছে চরম সত্য। অস্বীকার করার উপায় নেই, জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রায় সব নারীই সম্মুখীন হয়েছেন যৌন হয়রানির। আর এসব ঘটনা ঘটিয়েছেন পুরুষেরাই। অর্থাৎ, যৌন হয়রানি করেছেন—এমন পুরুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পরিবারে, বাসে, ট্রেনে, চলতি পথে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নারীকে যৌন হয়রানি করে চলেছেন অনেক পুরুষ।
মি টুর পরই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এসেছে হ্যাশট্যাগ আইহ্যাভ ক্যাম্পেইন। সুইডেনসহ এই ক্যাম্পেইন ছড়িয়েছে বিশ্বের অনেক দেশেই। পুরুষেরা সেখানে স্বীকার করছেন, নিজেদের অপরাধের কথা। আমাদের দেশে সাড়াটা কম। যে কয়জন পুরুষ এই ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা বলছেন, কখনো যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটাননি।
অপরাধ স্বীকারের ক্ষেত্রেও অবশ্য পৌরুষের দাপট চোখে পড়েছে। যৌন হয়রানি করাটা অপরাধ নয়, কৃতিত্ব হিসেবে মনে করছেন অনেকে। নারীরাও তাঁদের স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন সে কথা। অনেক পুরুষ আবার এ ধরনের স্বীকারোক্তিকে বোকামি বলে মনে করছেন। করছেন উপহাস। স্বাগতও জানিয়েছেন অনেকে। অন্য পুরুষদেরও সাড়া দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
সিলেটের থিওরেটিক্যাল চলচ্চিত্র নির্মাতা এঋক কায়সার আইহ্যাভ ক্যাম্পেইনে বলছেন, ‘ছি ছি ছি ছি ছি ডারমিক! হোয়াট এ হরিবল ওয়ান টু ওয়ান! আইহ্যাভ নেভার সিন লাইক দিস ইন মাই লাইফ! এইটার মূল্য দিতে হবে সুইসদের!’
হ্যাশট্যাগ আইহ্যাভ এ দেশে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক ইশরাত জাহান উর্মি। ফেসবুকের স্ট্যাটাসে তিনি বলছেন, ‘সুইডেন থেকে এবার #IHAVE বলে আরেকটা ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। যেখানে পুরুষেরা নারীর সঙ্গে যেসব অন্যায্য আচরণ করেছেন, তা স্বীকার করছেন। বাংলাদেশে #Me Too কাজ করলেও হ্যাশট্যাগ আইহ্যাভ কাজ করবে না আমি লিখে দিলাম। গণপরিবহনে…অশ্নীল মন্তব্য করা, ভিড়ের মধ্যে চান্সমতো হাত চালানো এবং শেষাবধি ধর্ষণ সাফল্যের সাথে করে ফেলা অধিকাংশ বাঙালি পুরুষ এইগুলারে কুনো দোষই মনে করে না। আগে তো দোষ বইলা মনে করতে হবে তারপরে না স্বীকার করা! হ্যাশট্যাগ আইহ্যাভ এ দেশে যথাসম্ভব মারা খাবে।’
কিছুটা সাহস দেখিয়েছেন কলকাতার প্রকৌশলী দত্ত সৌম্যজিত। তিনি বলছেন, ‘স্বীকারোক্তি তো সেই কবে থেকে আমার কবিতাগুলোর মধ্যে দিয়ে এসেছি। এগিয়ে আসা তো অনেক আগেই শুরু করেছি।’
হয়তো যৌনতা নিয়ে সামাজিক ট্যাবু কম হওয়ার কারণেই পাশ্চাত্যে পুরুষের সাড়া বেশি। অনেক পুরুষই অকপটে স্বীকার করেছেন, নিজেদের দুর্বল মুহূর্ত বা অপরাধের কথা। ক্ষমা চেয়েছেন, সেই নারীর কাছে, যাঁকে একসময় তিনি হেনস্তা করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার শিক্ষার্থী এরিন ডার্লিং হ্যাশট্যাগ আইহ্যাভ ক্যাম্পেইনে বলছেন, নিজের মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে তাঁর। বান্ধবীকে শারীরিক সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলেন তিনি। পরে বান্ধবীকেই দোষারোপ করেন সম্মতি দেওয়ার জন্য। মুহূর্তের আনন্দের জন্য তিনি পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত হয়েছেন। অনেকের দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়েছেন। অবলীলায় তিনি বলেছেন, ‘আমি ভালো নই।’ (ভাষান্তরিত ও সংক্ষেপিত)
ওয়াশিংটনের জেফারসন টি ডো হ্যাশট্যাগ আইহ্যাভে অকপটে স্বীকার করেছেন নিজের অপরাধ। বলছেন, ‘মি টুতে যৌন হয়রানির শিকার নারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, পুরুষ তাঁর যৌন নিপীড়নের কথা স্বীকার করবেন কি না? সেই আহ্বানেই তিনি সাড়া দিয়েছেন। যৌন হয়রানির শিকার সব নারীর উদ্দেশে স্বজাতির হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, সাবেক সঙ্গিনীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে তাঁর বিশ্বাস ভেঙেছেন। নিজের কাছের এক মেয়েবন্ধুর অগোচরে তাঁকে স্পর্শ করেছিলেন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ও পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন। নিজেই এর কারণও খুঁজে বের করেছেন। জানিয়েছেন, পৌরুষের গর্ব আর যা ইচ্ছা তাই করতে পারার মনোভাব থেকেই এমন আচরণ করেছেন। চারপাশের পরিবেশ তাঁকে নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবেই ভাবতে শিখিয়েছে। নারীকে অশ্রদ্ধা করা ও অপব্যবহারই শিখেছেন তিনি। তার বাবা ও এক শিক্ষককেও তিনি এমন আচরণ করতে দেখেছেন।’ (ভাষান্তরিত ও সংক্ষেপিত)
অরেগনের চলচ্চিত্র নির্মাতা জন মেয়ের কোনো অজুহাত দেখাননি। কেবল দুঃখ প্রকাশ করেছেন নারীদের যৌন হয়রানি করার জন্য।
পাশ্চাত্যের সবকিছুই ভালো। কেবল বাঙালিই যত খারাপের মূল। এমন ধারণা আমাদের মজ্জাগত। সেই ধারণারই ধারাবাহিকতা দেখা গেছে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চক্রপানি দেববর্মণের মনে। হ্যাশট্যাগ আইহ্যাভ ক্যাম্পেইনে তিনি বলছেন, ‘যৌন হয়রানি না করার জন্য আমি শতভাগ গর্বিত পুরুষ। কিন্তু আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত, ভারত ও বাংলাদেশে এ ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা বেশি হয়। বিদেশিদের এই অভ্যাস নেই।’
তবে তাঁর ধারণাকে তুড়ি মেরে সুইডেনের জন হলমগ্রিন বলছেন, আমি কখনো কোনো নারীকে যৌন হয়রানি করিনি। কিন্তু এটা কি সত্যিই বিশেষভাবে বলার মতো কিছু। আসলে এমনটাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে তা হয়নি। উল্টো যাঁরা আইহ্যাভে যৌন হয়রানির স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে। (ভাষান্তরিত ও সংক্ষেপিত)
মি টুতে সাড়া দিয়েছেন আমাদের নারীরা। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, যৌন হয়রানির শিকার হওয়াটা লজ্জার নয় বরং যৌন হয়রানি করাটাই লজ্জার। প্রশ্ন তুলেছেন, যৌন হয়রানির শিকার নারীরা কেন সমাজের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন? অকপটে জানিয়েছেন নিজেদের হয়রানির কথা। তবে আমাদের দেশে ততটা সাড়া মেলেনি পুরুষদের কাছে। তাঁরা থেকেছেন মুখোশের অন্তরালেই।