নিজের মুখে অন্যের মুখমণ্ডল লাগিয়ে বেঁচে আছেন তিনি
---
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :দিনটি ছিল গত বছরের ১৬ জুন। বিশ্বের বিরলতম অস্ত্রোপচারের একটি সম্পন্ন করার জন্য হুইল চেয়ারে করে অ্যান্ডি স্যান্ডনেসকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মায়ো ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটারে। এরপর পেরিয়ে গেল তিন সপ্তাহ। তারপর…
চিকিৎসক অ্যান্ডির মুখের সামনে এনে ধরলেন একটি আয়না। তখনই রীতিমতো তাজ্জব বনে যান তিনি। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কী বলবেন ভেবেও পাচ্ছিলেন না। তিনি অভিভূত। এতটা আশা করেননি।
হ্যাঁ, মুখমণ্ডল একেবারে নতুন হয়ে গেছে তার। সেখানে বসেছে অন্য এক লোকের মুখমণ্ডল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। কিছু বলতে চান, কিন্তু পারছেন না। নার্স এসে একটি স্পাইরাল করা নোটবুক এগিয়ে দিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে সেখানে অ্যান্ডি লিখলেন, ‘যা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি।’
মুখমণ্ডল প্রতিস্থাপনের আগে ও পরে অ্যান্ডি
অ্যান্ডি স্যান্ডনেসের মুখমণ্ডলে এখন ক্যালেন রসের মুখ। মুখমণ্ডল প্রতিস্থাপনের পর নতুন করে বাঁচার আনন্দ খুঁজে পেয়েছন অ্যান্ডি। প্রশ্ন হচ্ছে- কী ঘটেছিল, যার কারণে ক্যালেনের মুখমণ্ডল নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে অ্যান্ডিকে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে অন্তত এক দশক।
২০০৬ সালের নভেম্বর। অ্যান্ডির বয়স তখন ২১। সেই সময়টায় একদিন নেশার ঝোঁকে জীবনকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। রাইফেল দিয়ে গুলি করে বসেন নিজের মুখেই। কিন্তু ততক্ষণে নেশা কেটে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন, মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন। এদিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে পুলিশ। পুলিশের সেই কর্মকর্তা আবার অ্যান্ডিরই বন্ধু। তার হাতটি এমনভাবে ধরে থাকেন, যেন বলতে চান, ‘দয়া করে আমাকে মরতে দিস না। আমি মরতে চাই না।’
ছুটে আসেন অ্যান্ডির মা। একটা বুলেট এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছে ছেলের মুখ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মা। জ্ঞান ফিরলে কাগজের ওপর কলম দিয়ে আঁচড় কেটে ক্ষমা চায় ছেলে। বাঁচতে চায় অ্যান্ডি। ভালোভাবে বাঁচতে চায়। কিন্তু কীভাবে সম্ভব?
তাকে নিয়ে যাওয়া হয় প্লাস্টিক সার্জন ডা. সমির মারদিনির কাছে। চিকিৎসক আশ্বাস দিলেও এসবকে শুধু সান্ত্বনাই মনে করেন অ্যান্ডি। কিছু বলারও আর সুযোগ ছিল না। কারণ মুখ বলে আর কিছু নেই তার। নাক, চোয়াল, ঠোঁট- সবকিছু শেষ করে দিয়েছে সেই বুলেট। খাওয়া আর নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য টিউব ব্যবহার করতে হতো।
ডা. মারদিনি প্রথমেই তার আটটি অস্ত্রোপচার করেন। নিজের শহর ওয়াওমিংয়ে ফিরে যান অ্যান্ডি। সেখানে গিয়ে পেশা বেছে নেন তিনি। লজে কাজ করেন, তেলের কূপে কাজ করেন, ইলেক্ট্রিশিয়ানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু কোনো কিছু স্বাভাবিক নয়। কারো মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতেন না, বিশেষ করে শিশুদের দিকে- তারা তার বীভৎস মুখ দেখে ভয় পেয়ে যাবে!
অ্যান্ডির মুখগহ্বরটা মাত্র এক ইঞ্চি। একটা চামচ পর্যন্ত ঢোকানো যায় না। তাই যেকোনও খাবার একেবারে টুকরো টুকরো করে কেটে খেতে হয়। কৃত্রিম নাকটা প্রায়ই খুলে পড়ে যায়। তাই সঙ্গে আঠা রাখতে হয়। পড়ে গেলে তা তুলে লাগিয়ে নেয়ার জন্য।
২০১২ সালে আশার আলো জেগে ওঠে অ্যান্ডির। মিনেসোটার রচেস্টারের মায়ো ক্লিনিক থেকে ডা. মারদিনি ফোনে জানান, তার ক্লিনিক মুখমণ্ডল প্রতিস্থাপনের কর্মসূচি নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তিনি অ্যান্ডির মুখমণ্ডল প্রতিস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু দাতা পাবেন কোথায়?
এরপর আরও চার বছরের অপেক্ষা। ২০১৬ সালে মিলে যায় দাতা। মিনেসোটারই ক্যালেন রস (২১)। একটা জায়গায় অ্যান্ডির সঙ্গে রসের মিল। দুজনেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এই চেষ্টায় অ্যান্ডি ব্যর্থ, কিন্তু রস সফল!
তার ১৯ বছরের স্ত্রী লিলি জানান, মৃত্যুর আগে রস তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন। সেইমতো তার হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার আর কিডনি দান করা হয়। কিন্তু রসের দেহ পরীক্ষা করে দেখা যায়, আরও কিছু দান করতে পারেন তিনি। তার মুখমণ্ডল মায়ো ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অ্যান্ডির মুখমণ্ডলে প্রতিস্থাপন করা যায়।
লিলি বলেন, ‘আমি প্রথমে খুব একটা রাজি ছিলাম না। আমি চাইনি পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ দেখব আমার স্বামী রস ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ তবে চিকিৎসকরা আশ্বাস দেন, অ্যান্ডির চোখ ও কপাল তার নিজেরই থাকবে, চোখের নিচ থেকে বাকিটা প্রতিস্থাপন করা হবে। তাই হুবহু তার স্বামীর চেহারা অ্যান্ডি পাবেন না।
মায়ো ক্লিনিকে গত বছর জুন মাসে এই বিরল ও জটিল অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসক সামির মারদিনি। ৫৬ ঘণ্টার ম্যারাথন অপারেশন দেখতে পাশের কক্ষে ভিড় জমিয়েছিলেন প্রায় ৬০ জনের একটি দল, যার মধ্যে ছিলেন সার্জন, নার্স, অ্যানেস্থেটিস্ট ও আরও অনেকে।
ক্যালেন রস
এরপর ধীরে ধীরে অ্যান্ডি এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। মুখের মাংসপিণ্ডগুলো একটু একটু করে শক্ত হচ্ছে। নতুন মুখগহ্বর আর চোয়াল নিয়ে জিহ্বা ব্যবহার করে কী করে কথা বলা যায় তার জন্য থেরাপি চলছে। আবার গন্ধ পাচ্ছেন, স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিচ্ছেন। স্বাদ নিচ্ছেন আপেল, পিজা আর স্টিকের।
বর্তমানে ৩১ বছরের অ্যান্ডি আবার ফিরে যাবেন ওয়াওমিংয়ে। ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করবেন, বিয়ে করবেন- এমটাই প্রত্যাশা তার। মাঝে একটা আইস হকি ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন। পপকর্ন খেতে খেতে খেলা দেখছিলেন। দেখলেন, কেউ তার দিকে আর ভয়ে ভয়ে বা আড়চোখে তাকাচ্ছে না, কেউ তাকে দেখে আর ফিসফিস করছে না।