শুক্রবার, ১৪ই জুলাই, ২০১৭ ইং ৩০শে আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকার পাঠ্যপুস্তক কেজিদরে বিক্রি

AmaderBrahmanbaria.COM
জুলাই ৩, ২০১৭
news-image

---

‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল’এই প্রবাদ বাক্যের অকাট্য রূপ পাওয়া যায় আমাদের সরকারি সম্পদ ‘বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক’ ব্যবস্থাপনায়। যে বইটির উৎপাদন খরচ ১৯ টাকা; বিতরণ শেষে উদ্বৃত্ত থাকা সেই বইটিই কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১ টাকায়! বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকার পাঠ্যপুস্তক উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে গুদামঘরে। পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা নিরূপণ, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হওয়ায় অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা।
জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষে সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের পরও ১ কোটি ৬৯ লাখ ৮ হাজার ৯৫৯ পাঠ্যপুস্তক উদ্বৃত্ত থেকে গেছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৪০ লাখ ৫ হাজার ৬২৮, ২০১৪ সালে ৬৩ লাখ ৫ হাজার ৬৬৫ এবং ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ৬৫ লাখ ৭ হাজার ৬৬৬ পাঠ্যপুস্তক উদ্বৃত্ত ছিল। তবে এর আগে ও পরের কোনো তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।

এ ছাড়া সারা দেশে ৫০৯ কেন্দ্রের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এর মধ্যে ৩৩৫ কেন্দ্র (৬৬ শতাংশ) পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা, প্রাপ্তি, বিতরণ ও উদ্বৃত্তের তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি ১৭৪ কেন্দ্রে যথাযথভাবে সংরক্ষণ নেই। উপজেলা পর্যায়ে প্রতি শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তক উদ্বৃত্ত থাকছে।
মাঠপর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসনের মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তাদের চাহিদা নিয়ে প্রতিবছর ছাপানো হয় কোটি কোটি পাঠ্যপুস্তক। এসব বই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। বৈদেশিক ঋণ ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে তৈরি করা হয় এসব পাঠ্যপুস্তক। শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয় ২০০৯ সালে। এর পর থেকে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, একটি বই ছাপাতে এনসিটিবির ব্যয় হয় ১৯ টাকা ৮৫ পয়সা। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিতে বই রয়েছে ১৪টি করে। এই শ্রেণির এক সেট বই ছাপাতে খরচ হয় ২৭৭ টাকা ৯০ পয়সা। এ ছাড়া নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শাখা বিভাগে ১৮টি করে এবং মানবিক বিভাগে ১৭টি বই পাঠ্যক্রমে রয়েছে।
এনসিটিবির তথ্যানুযায়ী, ওজনে হিসাব করলে এক কেজি হয় ৯টি বইয়ে। এক শ্রেণির ১৪টি বইয়ে দেড় কেজির মতো ওজন। কিন্তু সরকারি বিধান অনুযায়ী, গুদামে থাকা উদ্বৃত্ত ও নষ্ট বই প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রির সর্বনিম্ন দর কেজিপ্রতি ১০ টাকা। অর্থাৎ এক সেট বই তৈরিতে সরকারের ব্যয় ২৭৭ টাকা ৯০ পয়সা। নিলামে এর বিক্রয়মূল্য হয় ১৫ টাকা। প্রতিসেটে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ২৬২ টাকা ৯০ পয়সা। এ হিসাবে ২০১৩-১৫ সালের শিক্ষাবর্ষের উদ্বৃত্ত ১ কোটি ৬৯ লাখ ৮ হাজার ৯৫৯টি পাঠ্যপুস্তকের উৎপাদন মূল্য ৩ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৬ টাকা। এসব বইয়ের ওজনে হিসাব করলে ৪ হাজার ৫৪৪ মণ, যার বিক্রয়মূল্য মাত্র ১৮ লাখ ১৭ হাজার ৮৮০ টাকা মাত্র।
পাঠ্যপুস্তক অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আর তাই সরকারের সব সম্পত্তির মালিকও জনগণ। জনগণের অর্থের, সম্পত্তির ভয়াবহ অপচয়, তথা দরিয়ায় ঢেলে ফেলে দেওয়ার মতো অপকীর্তি কারা করেন? সেগুলো কখনো উদ্ঘাটন হয় না বলেই রাষ্ট্রীয় অপচয় ঘটছে।
পাঠ্যপুস্তক উদ্বৃত্ত থাকার কারণ
কোনো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক-দুই সেট বই উপজেলা কার্যালয়ে ফেরত দিয়েছেন। তাদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। আবার এর বিপরীত হয়েছে, চাহিদার পর ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে আশঙ্কা থেকে উপজেলা অফিসে অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে বই নিয়েছেন। এ ছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সঠিক চাহিদা নিরূপণ করা যায়নি। উদ্বৃত্ত বইয়ের বেশিরভাগ ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির। কেননা নবম শ্রেণির বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শাখায় কতজন শিক্ষার্থী পড়বে এটির অগ্রিম হিসাব করাও জটিল। এ ছাড়া চতুর্থ বিষয় কোন শিক্ষার্থী কোনটি নেবে, সেটিও অগ্রিম ধারণা করা যায় না। অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা গার্হস্থ্য অর্থনীতি নেয় না, তারা কৃষি শিক্ষা পড়ে। সাধারণ ২০১৭ সালে শিক্ষার্থীদের যে বই দেওয়া হয়, তার চাহিদা নিরূপণ করা হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অথবা যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা মেটাতে দুই শতাংশ বাড়তি বই ছাপানো হয়।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, আগামীতে পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা নিরূপণ, উৎপাদন, বিতরণ ব্যবস্থাপনার আরও কার্যকর কৌশল নির্ধারণের বিষয় ভাবছে সরকার। সে জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এনসিটিবিতে ডেকে এনে বৈঠক করা হয়েছে। বৈঠকে তারা জানিয়েছেন, চাহিদা নিরূপণে গরমিলের কারণÑ সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায় ফেল করা, শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়া, একাডেমিক সেশন শুরুর আগেই পাঠ্যপুস্তকের সম্ভাব্য চাহিদা প্রেরণ করা, পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা ও ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অমিল থাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত
বিগত কয়েক বছরে সরকারি গুদামে অনেক পাঠ্যপুস্তক থেকে গেছে। এগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিছু বই স্কুলের লাইব্রেরিতে দেওয়া হবে। কিছু বই শ্রেণিতে পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের দেওয়া হবে। বাকি বই সরকার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে দেবে। সর্বনিম্ন ১০ টাকা কেজিদরে এসব বই বিক্রি করতে হবে। এর অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে। দৈনিক আমাদের সময়

এ জাতীয় আরও খবর