বাঁশির গ্রাম শ্রীমর্দ্দি : বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশি শিল্প বিলুপ্তির পথে।ঋণে জর্জরিত কারিগররা
---
বিশেষ প্রতিবেদন : ফয়সল আহমেদ খান, বাঞ্ছারামপুর-হোমনাস্থ বাঁশির গ্রাম শ্রীমর্দ্দি থেকে ফিরে : ‘‘বাঁশি শুনে আর কাজ নেই…সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি…’’-জনপ্রিয় গানটির প্রথম পঙতিটির ‘বাঁশি’-কে ডিজিটাল যুগে নানা বাহারী কৃত্রিম ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমের ছোঁবলে বাঁশির কদর কিছুটা কমলেও বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনো বাঁশি শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখাসহ শ্রীমর্দ্দী গাঁয়ের অধিকাংশ পরিবারের মানুষ এর উপর ভর করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে সেই নবাব সিরাজদৌল্লার আমল থেকে।
মেঘনা নদীর কোঁল-ঘেঁসা ছোট্র দ্বীপের মতো গ্রাম হোমনা পৌরসভার দক্ষিণে অবস্থিত শ্রীমর্দ্দির বাঁশির গ্রাম,এই গ্রামের বেশীর ভাগ অংশজুড়ে রয়েছে বাঁশিপাড়া মহল্লাটি। মেঘনার চরে গড়ে ওঠা শ্রীমর্দ্দির রয়েছে বাঁশি তৈরীর সুদীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস।
গ্রামটিতে মাত্র ১৯ হাজার লোকের বসবাস করলেও যুগের আবর্তে বর্তমানে প্রায় গোটা ত্রিশেক পরিবারের প্রায় ২ শতাধিক সদস্য/সদস্যা কেবল বাঁশি শিল্পকে পুঁজি করে দিনপাড়ি দিচ্ছে।যদিও বাঁশি-কারিগরগন কেউ স্বচ্ছল নয়,তবু তারা বসবাস করছে ভিন্ন আমেজ আর নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে।
এ-গাঁয়ে যেমন রয়েছে তুঁখোড় বাঁশি বাজানেওয়ালা বা বাঁশঁরিয়া বাউল ইব্রাহিম ফকির,ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম,হাসু ফকির,সিরাজুল ইসলাম,করম আলী তেমনি গায়ের তৈরী উন্নতমানের বাঁশি বাংলার সুনাম অক্ষুন্ন রেখে মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র্র,লন্ডন,জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কসহ ইউরুপের আরো অনেক রাষ্ট্রে আধুনিক প্রযুক্তিকে হার মানিয়ে রপ্তানী-ও হচ্ছে।বজায় রেখেছে শত বর্ষের আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশি শিল্পটি।
কথা হয় ১৬ বছরের তরুন মফিজ মিয়ার সাথে।সে জানায়,-‘আমি ছুডু সময় (৮ বছর বয়সে)থেইক্ক্যা বাঁশি বানাইতে পারি। কেউ শিখাইয়া দেয় নাই।আব্বা-আম্মার বাঁশি বানানো দেইখ্যা শিখছি।অহন তো আমার লগে কেউ পারতো না।জমিতে বদলি দিয়া আমার বন্ধু হারিছ ডেইলি পায় ১০০ টাকা,আমি আপনাগো দোয়ায় সিজনের সময় কামাই ১৭০ থেইক্ক্যা ২শ টাকা’।বাঁশির গ্রাম শ্রীমর্দ্দি ঘুরতে-ঘুরতে কথা হয় আরেক বাঁশি কারিগর প্রাথমিক স্কুল গন্ডি পেরোনো গোপাল সরকার (৩২),অনিল সরকার (২২) ও তাদের মা রেখা রানীর (৫৫) সাথে।বাড়ীর উঠোনে জলচৌকীতে বসে তাদের দেয়া মুঁড়ি-মুন্ডা ও টোষ্ট বিস্কিট খেতে-খেতে কথা বলতে থাকি,ছুটে যাই বাঁশিপাড়ার এঘর থেকে ওঘরে।
এক সময় পাশের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন বাঁশিপাড়ার কারিগরদের ওস্তাদ অনিল বিশ্বাস(৫০)।বাঁশি ব্যবসার সাথে জড়িত বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লার যন্ত্রসংগীতের সাথে জড়িত প্রায় সবাই বাঁশির স্বনামধন্য নিপুন কারিগর অনিল বিশ্বাসের নামটির সাথে পরিচিত।তিনি বলেন,-‘ছোট বেলায়ই বাঁশি রং,বার্ণিশ,চাক্কি,ছিদ্র করা শিখছি।অহন বিদেশী-গো জন্য স্পেশাল বাঁশি কারুকাজ করা নানা বাহারী ডিজাইনের বাঁশি বানাই। প্রতিবেশী গোপালের মতে, এই মৌসুমে হাতে কাজ থাকে বেশী।কারন,বৈশাখ মাসে দেশ-বিদেশের বাঙ্গালীদের কাছে বাঁশি কঁদর বেশী থাকে।ঢাকার পাইকাররা ফোনে বেশী-বেশী বাঁশি বানানোর জন্য অনুরোধ আসে।চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয় কেবল পুঁজির অভাবে।
পাড়ার সব কারিগরদের একটি বিষয়ে একমত।বাঁশি তৈরীর কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও সিজনের সময়(চৈত্র-বৈশাখ)টাকা দিয়ে চট্রগ্রাম অঞ্চল থেকে বাঁশি তৈরীর উপযোগি বাঁশ পাওয়া যায় না।আগে (৫-১০ বছর আগে) ৪০-৫০ হাজার টাকা পুঁজি খাটালেই এই শিল্পে অনেক লাভ হতো।আর এখন,২-৩ লাখ টাকা প্রয়োজন বাঁশি তৈরীর সব সরঞ্জাম কিনতে।অথচ লাভের পরিমান খুব কম।সবকিছুর মূল্য পাল্লা দিয়ে বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাঁশির মূল্য সেই হারে বাড়েনি।
যেভাবে তৈরী হয় একটি বাঁশি :
দিনভর কারখানায় বসে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখি বাঁশি তৈরীর কয়লার আগুনের সৃষ্ট প্রচন্ড তাপ সহ্য করে বাঁশি বানানোর কষ্টকর পদ্ধতি।প্রশ্ন করে জেনে নেই প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো।এ গাঁয়ের সব কারিগররাই বাঁশি তৈরীর প্রধান কাচামাল বাঁশ ৮/১০জন কারিগর মিলে মিনিট্রাকে করে সংগ্রহ করেন সেই খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি থেকে,ফলে যাতায়াত খরচ খানিকটা রক্ষা হয়।জানাগেছে,-সেখানেও কয়েক বছর ধরে উপযোগী বাঁশের আঁকাল পড়েছে।ইদানিং ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে চোরাই পথে বাঁশ কিনতে হচ্ছে।বাঁশের হিসেব হালি,ডজনে নয়,-গুনতে হয় প্রতি কাউন হিসেবে।১হাজার ৩’শ বাঁশের কঞ্চি হলো ১ কাউন।পূর্ণবয়স্ক চিকন-সরু জাতীয় মুলিবাঁশ (কঞ্চি) ভেঁজা থাকে বিধায় দিনদুয়েক রোদে শুঁকানো হয়।পরে বাঁশির ধরন, মাপ,অর্ডার অনুযায়ী সাবধানে খুব ধারালো চিকন দাঁ দিয়ে খন্ড-খন্ড করে কাটা হয়, এরপর চলে ফিনিশিং।কয়লার আগুন (কামারদের দোকানে যেমনটি থাকে) তীব্রতা প্রায় হাজারের উপর(ফারেনহাইট হিসেবে) তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সে আগুনে মোটা পেরেকের মতো লোহাটি গরম হয়ে যখন লালবর্ণ ধারন করে তখনই শুরু হয় ঝুঁকি-যুক্ত বাঁশির ছিদ্র করার আসল কর্মটি।বাঁশির সুর-তাল-লয় মিলানোর জন্য বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী ছিদ্র করা হয়।ঐ অবস্থাতেই পাশে থাকা বড় আকৃতির গামলায় কৃত্রিম বহু রঙ্গের পানিতে-সদ্যছিদ্রযুক্ত বাঁশিটিকে ডুবানো হলে নানা কালারের বাঁশির বাহ্যিক রুপি পেয়ে যায়।এরপর আবার শুকানো পর বার্ণিশ,লেছ,টিন.লোহা,কারুকাজ ও গ্লেস দেয়া হয়।ব্যাস হয়ে গেল বাঁশি।
বাঁশির প্রকারভেদ ,মূল্যনির্ধারন
ঐতিহ্যবাহী সব শিল্প পণ্যের মতো বাঁশিরও রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের।নানা নামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব বাহারী বাঁশি ব্যবহার হয়।যেমন,সচরাচর হাটে, মাঠে-ঘাটে ও বিভিন্ন মেলায় শিশুরা যে বাঁশি সবচেয়ে বেশী কেনা-বেঁচা হয় এর নাম মুখ বাঁশি।মুখবাঁশির মূল্য সবচেয়ে কম। তবে,মুখবাঁশিরও রয়েছে আরো ১০ থেকে ১২ রকমের প্রকারভেদ। এর মধ্যে তুলনামূলক আরো সস্তায় গ্যারান্টিবিহীন বাঁশিটিকে সবাই একনামে চেনেন বেলুনবাঁশি ও তাঁলবাঁশি হিসেবে।এর পাইকারী মূল্য মাত্র ২ থেকে ১০টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।গল্প-উপন্যাসের রাজকন্যারা যে বাঁশির সুরে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কুঁড়ের ঘরের বামনের হাত ধরে চলে আসতেন সেই বাঁশিটির নামও ৩ ঐতিহ্যবাহী নামে পরিচিত-‘রাজ/নবাবী/শাহী বাঁশি’।হালের সিনেমায় মডার্ন মেয়েদের হ্নদয় তোলপাড় করে,-এর নাম প্রেমের বাঁশি।প্রেমের বাঁশি তৈরীতে নানা বাহারী ডিজাইনের লেইছ ফিতা,জরি,ক্যামিকেল গ্ল্যেস দেয়া হয় ঝিঁকঝাঁক করে তোলার জন্য।কবি নজরুল ইসলামের বিঁষের বাঁশি উপন্যাসটি লিখেছিলেন আড়বাশিকে কেন্দ্রকরে,যা তার বিভিন্ন ছবিতে বাশি সমেত কবিকে দেখা যায়।কবি গোলাম মুস্তফার রাখাল বন্ধু ,নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস-নাটকে,এবং তার ড্রইংরুমে শোভাপাচ্ছে আড়বাশি। লেখক-কবিরা তাদের লিখায় রাখালিয়াদের যে বাঁশিটির কথা ইঙ্গিত বেশী ব্যবহার করেছেন,এটি ঠোঁটে দুহাতে আড়াআড়ি ভাবে ধরে যে বাঁশি বাজাতে হয়।তাই নামকরন করা হয়েছে রাঁখাল বাঁশি বা আড়বাঁশি।গম্ভীরা-রাগ সংগীতে যে বাঁশি ছাড়া সংগীত হয়ে যাবে বেসুরা,-তার নাম বীণবাঁশি।সিনেমা-নাটকে বা সাঁপুড়েরা যে বাঁশিটি ব্যবহার করেন একে সবাই নাগিন বাঁশি বলে সমধিক পরিচিত।নাগিনবাঁশি তৈরী করতে একবেলা সময় (প্রায় ৪ ঘন্টা) ব্যায় হয় বলে কারিগররা জানান।ভারতের মাদ্রাজ-আসাম-ত্রিপুরা ও পাকিস্তানের শিয়ালকোটে এর উৎপত্তিস্থল এবং এখনো এটি সমধিক জনপ্রিয়।বাশিটি তৈরীতে বেশী সময় লাগে এর আকর্ষণীয় নঁকশা-কাঁরুকাজ ও বিশেষ ধরনের ছিদ্র করতে হয়।আর এই কারনে এর মূল্যও অনেক বেশী।নাটক-সিনেমা বা সংগীত জগতের বিখ্যাত বংশীবাদকেরা এর জন্য ৮/১০ আগে অর্ডার সাপেক্ষে নাগিন বা বীণবাঁশি তৈরী করতে ২ থেকে ৩ দিন খাঁটুনী দিতে হয় বলে জানান রতন বিশ্বাস।এর অর্ডারের প্রেক্ষিতে প্রকারভেদে দাম পড়ে ৫’শ থেকে ১ হাজার টাকা।তাই সবাই এর নামকরন করেছেন স্পেশাল বাঁশি। শ্রীমর্দ্দী থেকে স্পেশাল বাঁশি নিয়ে ব্যবহার করছেন উপন্যাসিক ও নাট্যব্যক্তিত্ব প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ,বিখ্যাত যাদু শিল্পী জুয়েল আইচ,বাঁশি সম্রাট হিসেবে টিভি মিডিয়ায় ব্যাপক পরিচিত ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম,ক্ষুদেগান রাজের বংশীবাদক শহীদ,রেডিও-টিভির ১ম শ্রেনীর তালিকাভূক্ত বাঁশি সংল্লিষ্ট শিল্পী আবুল বাশার,ফোঁকগান ও বাউল সংগীতের সাথে কাজ করছেন এমন অর্ধশতাধিক শিল্পীর নিজস্ব বংশীবাদকরা এই গ্রাম থেকে বাঁশি এডভান্স টাকা পাঠিয়ে কিনে নিয়ে যান বলে জানান বাঁশির কারিগরদের ওস্তাদ অনিল বিশ্বাস।এদের মধ্যে বিশেষ করে রয়েছেন আবদুর রহমান বয়াতি, কুদ্দুস বয়াতি,মাখন দেওয়ান, কানা(অন্ধ) সামসু, মনির খান,দেওয়ান শরিফউদ্দিন,আকলিমা,আলেয়া (আলো হিসেবে পরিচিত),রেখা রানী প্রমূখ।
এক বংশীবাদকের কথা-
বংশীবাদক দেওয়ান শরিফউদ্দিন বলেন,আমি রেডিও-টিভিসহ বাউল সংগীতে শ্রীমর্দ্দি গ্রাম থেকেই প্রায় ১০ বছর বাশি বাজিয়ে শ্রোতাদের মনে ঠাই পেয়েছি।আমার জন্মও এগায়ে।এজন্য দেশের জেলা-উপজেলাগুলোতে বাউল সংগীতের কোন সংগঠন না থাকলেও হোমনা সদরে অফিস নিয়ে বংশীবাদকদের নিয়ে তাদের সুবিধা-অসুবিাধাগুলো দেখছি।এখানকার বাঁশীগুলো শিয়ালকোটের বাঁশি মতো নিপুন হাতের শৈল্পিক সৌন্দর্য্য রয়েছে।মানসম্মত।
নারীরা বাঁশি তৈরীতে এগিয়ে
দিনভর বাঁশিকারিগরদের প্রায় ১০টি বাড়িতে ঘুরে-ঘুরে লক্ষ করেছি পুরুষের চেয়ে নারীরাই বাঁশি বানাতে পারঙ্গম।ওদের কাজও হয় নিখুত।অনিল বিশ্বাসের ৫ মেয়ের সবাই বাঁশি তৈরী শিখে ফেলেছে শিশু বয়সেই।অনিলরা ৫ ভাই।এদের সবার ঘরের বধূরা এই পেশায় জড়িত।অনিলের স্ত্রী দূর্গতি বিশ্বাস (৪০)বলেন,-‘মাইয়াগো বাবা (অনিল)যহন রাতে ঘুমাইয়া পড়ে সিজনের সময় অনেক রাইত পর্যন্ত আমি বাশিতে বার্ণিশ,ফিনিশিং,টিন ইত্যাদি হাতের কাজ কইরা রাহি,এছাড়া আমার শাশুড়ী বাইচ্চ্যা থাকতে তিনিইও পোলার বাঁশির কামে আমারে লইয়া পাল্টাপাল্টি কইরা বাঁশি বানাইছি।হেগো থেইক্ক্যা আমরা বৌ-শাশুড়ী,আমাগো মাইয়ারা নানাভাবে সাহায্য করি দেইখ্যাইতো ভগবানের দয়ায় দেশের সবাই আমার স্বামীরে একনামে চিনে’।
বিসিক,বাংলাদেশ হঁস্ত ও কুঁটির শিল্প প্রস্তুতকারক ও রপ্তানীকারকের বক্তব্য:
অনিলের কাছে রয়েছে প্রায় শতাধিক বাঁশি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় ও বাদকের নাম-মোবাইল নাম্বার।তার কাছ থেকে মোবাইলে কথা হয় ঢাকা শহরের কাকরাইলের মোড়ের স্বরলিপির মালিক বোরহানউদ্দিন,আর্ট কলেজের সামনে অবস্থিত লাবু বাঁশি হাউস মালিক লাবুর সাথে।তারা জানায়,-‘ ঢাকায় আগত ৭০ ভাগ বাশিই আসে শ্রীমর্দ্দি গ্রাম থেকে।বাদবাকীগুলো ময়মনসিংহের তারাকান্দি উপজেলার নগুয়া গ্রাম থেকে’।
শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের জাহানারা কটেজ,সেগুনবাগিচার সুরের ভূবন বাঁশি বিক্রয়কেন্দ্রের মালিক রুহুল কুদ্দুছ শাহনেওয়াজ জানান,-‘৮০ দশকে প্রথম বাংলাদেশ থেকে চাহিদার প্রেক্ষিতে শুরু হয় বাঁশি রপ্তানী।তা ধীরে-ধীরে বাড়তে থাকে।আমরা রপ্তানী ব্যুরো ও হস্তশিল্প প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২ হাজার সালের দিকে তারা একাই প্রায় ৫০-৬০ হাজার বাঁশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠাই’।আমাদের মতো আরো বেশকয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে সে সময় বাঁশি রপ্তানী করে বেশ ভালই মুনাফা করা যেতো।কিন্তু ২০০৫ সালের পর থেকে বাঁশি শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা,সরকারি সহযোগিতা, কারিগরদের পুজির অভাব ও সর্বোপরী ডিজিটাল কৃত্রিম সাইন্ড সিস্টেমের কারনে প্রকৃত বাঁশির সুর হারিয়ে যেতে বসেছে।কেবল প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই শিল্পটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
রপ্তানীযোগ্য পন্য হওয়া সত্বেও সরকারের কোনমহল থেকেই বিষয়টি নিয়ে কখনোই আলোচনা করা হয়না।বিসিক ,বানিজ্য-শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এটি রপ্তানীর বিষয়ে কখনো উদ্যোগী হয়েছেন,এমন একটি উদহারন নেই। অনেক কর্মকর্তা রপ্তানীর জন্য বাঁশির নাম শুনলে যেন নাক সিঁটকান।যেন বাঁশির রপ্তানী বাড়লে দেশের মান বর্হিবিশ্বে কমে যাবে!
দেশে বাঁশি থেকে বাৎসরিক বৈদিশিক মুদ্রা আয় :
শ্রীমর্দ্দীর বাঁশিপাড়ার ওস্তাদ (ওরা নেতা বা সমিতির সভাপতি,দেখভালের দায়িত্বরত) বয়োজৈষ্ঠ্য হিসেবে অনিল বিশ্বাস জানান,-‘বাংলাদেশের ৪ ভাগের ৩ ভাগ বাঁশির চাহিদা মেটানো হয় এই বাঁশিপাড়া থেকে।দেশে অভ্যন্তরীন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখনো যারা খেয়ে না খেয়ে উচুহারে দাদনের(গ্রাম্য সুদ)মাধ্যমে ও ধার-দেনা করে সারা বছর প্রায় ৩০ লাখ বাশি তৈরী করছি আমরা।টাকার অংকে কোটি তিনেক হবে।বিদেশে আমরা সরাসরি বাঁশি পাঠাই না।পাইকারগন হাতবদলের মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে নাগিন,স্পেশাল,বীণ,শাহী/নবাবী/রাজ ও প্রেমের বাঁশি বেশী বিদেশে পাঠানো হয় বলে জেনেছি।এদিকে বাঁশি থেকে বছরওয়ারী সুনির্দিষ্ট রেমিনেন্স ‘আনুমানিক ও হতে পারে’অনুমান নির্ভর প্রায় অর্ধকোটি টাকা হতে পারে বলে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর হস্ত ও কুটির শিল্পশাখার কর্মকর্তা মো.মোসাদ্দেক হোসেন জানান,-‘বাঁশিকে আমরা ভিন্নভাবে শ্রেণীকরন করিনি।বাঁশ-বেত বা কুটির শিল্পের সাথে এটি গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।তাই কেবল শুধু বাঁশি নির্ভর বৈদিশিক আয় কতো বলা সম্ভব নয়’।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে বদেশে যাচ্ছে বাংলার বাঁশি-
বাংলার বাঁশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশ-ও রপ্তানী হচ্ছে,বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো ও বিসিকের মাধ্যমে।যার অর্ধেকের বেশী যোগান আসে শ্রীমর্দ্দি গ্রাম থেকে।বিসিকের পরিচালক রপ্তানী লোকমান হোসেন ভূইয়া জানান, গত অর্থবছরে বাঁশি রপ্তানী হয়েছে বাঙ্গালী অধ্যূষিত প্রবাসী বিভিন্ন দেশে।কিন্তু ঠিক,গেলো বছর ঠিক কত কোটি টাকার রপ্তানী হয়েছে তা জানাতে আমাকে সময় দিতে হবে।তবে এর আগের বছর দুইহাজার-এগারোতে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকার বাঁশি বিদেশে রপ্তানী হয়েছে।যার বেশীর ভাগই যোগানদাতা শ্রীমর্দ্দি গ্রামের কারিগররা।রপ্তানী উন্নয়ন বূরে্যার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন,-সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারনে দরিদ্র বংশীকারিগরদের স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।তবে-এমন প্রস্তাব আমরা ৫ বছর আগেই মন্ত্রাণালয়ে পাঠিয়েছি।
স্কুলে যাচ্ছে শিশুরা :
আজকের নতুন প্রজন্ম বাঁশি শিল্পটি সন্মানজনক পেশা হিসেবে মেনে নিতে পারছেনা। বর্তমান অভিভাবকদের ধারনা এই পেশাটির স্থায়িত্ব বা ভবিষ্যৎ নেই।ফলে-দিনে-দিনে কারিগরদের সংখ্যা শুধু গত ৫ বছরে প্রায় ৩০ভাগ কমে গেছে।
এই ভাবনায় বাঁশির কারিগর জয়নাল আবেদীন বলেন,-‘এর আগে গেলো বছর ২/৩ জন সাংবাদিক আইছিল,পত্রিকায় আমাগো সমস্যা নিয়া লেখছে-লাভের লাভ কিচ্ছু হয় নাই।সরকার আমাগো দিকে কোন সময় সুবিধা-অসুবিধা দেখে নাই।বাঁশির দিন মনে হয় আর টিকবো না।তাই আমগো ছেলে-মেয়েগো কাছের সরকারি পাইমারীতে ভর্তি করাইয়া দিছি।অনেকে হাইস্কুল পাশ দিছে’।জয়নালের ২ মেয়ে ২ ছেলে।২ মেয়েকেই দেখলাম বাবার কাজে সাহায্য করছে।জয়নালের মেয়ে নার্গিস ও রাবেয়া গর্ব ভরে জানায়,-‘আমরা হোমনা ডিগ্রী কলেজে দুবোন এক সাথে ভর্তি হয়েছি,অবসরে বাবাকে সাহায্য করি।ছোট ভাই ৯ম ও ৫ম শ্রেণীতে পড়ছে।
কারিগরদের আর্থিক সমস্যা ও এনজিওদের ফাঁদে বাঁশির কারিগর:
সারা বছর যে পরিমান বাঁশি তৈরী হয় তার চেয়ে বেশী বাঁশি তৈরী হয় চৈত্র মাসে নববর্ষ উপলক্ষ্যে বৈশাখী মেলাগুলোতে।এছাড়া সোনারগাঁ,চট্রগ্রামের জব্বারের বলি খেলায় প্রচুর বাশি বিক্রি হয়।ফলে শুধু একটি সিজনের ব্যবসা বিধায় বাঁশির কারিগর সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো বাকী ১১মাস পেট বাচাতে লড়াই করে ঁেবচে থাকেন।স্থানীয় এনজিও গুলো থেকে ঋণ তুলছেন প্রায় সবকটি বাঁশির পরিবার।কিস্তি ঠিকমতো দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তখন ভিন্ন এনজিও থেকে পুনরায় টাকা তুলতে থাকেন।আটকে যান কিস্তির ফাঁদে।সেই ফাঁদ থেকে রক্ষা পেতে আরো গভীর ফাঁদে এগোতে বাধ্য হন তারা।গ্রামের বিত্তবান দাদনব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একশত টাকায় মাসে ৬টাকা লাভ এই হারে সুদে টাকা তোলে বাঁচার জন্য লড়াই চালিয়ে যান।এজন্য ওস্তাদ অনিল বিশ্বাস দাবী জানিয়ে বলেন,-‘ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে অবিলম্বে সরকারকে নানাভাবে বিশেষ করে আর্থিক সমস্যা সমাধানে কারিগরদের কমসুদে ঋণদিয়ে পৃষ্টপোষকতা করতে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন,-‘রপ্তানীরজন্য কোরবানী ঈদে সিজনাল বিশেষ বরাদ্ধ হিসেবে সরকার কোটি-কোটি টাকা চামড়া ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহযোগিতা করলে ওদের মতো আমাদেরও বছরে এই চৈত্রমাসে যদি বিশেষ ঋণের সুবিধা দিতো,তবে শিল্পটির মর্যাদা, রপ্তানী,আধুনিকিকরন ও কারিগরদের অর্থাভাব দূর হতো।আক্ষেপ করে অনিল,প্রমিল, রতন ও জয়নাল বলেন,-‘তারা সবাই স্থানীয় এনজিও উদ্দীপন থেকে ১লাখ টাকা ঋণ তুলেছেন।