মাতামুহুরীর চিরচেনা যৌবন আর নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক : অনাদর, দূষণ, দখল, অবহেলা আর ড্রেজিংযের অভাবে মাতামুহুরী নদীর চিরচেনা যৌবন আর নেই। প্রমত্তা এ নদী বেশ কয়েক বছর ধরে পরিণত হয়েছে মরা নদীতে। দেশের অভ্যন্তরে উৎপন্ন হওয়া অন্যতম খরস্রোতা এ নদীর স্থানে স্থানে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট বড় চর।
এসব চরে চাষ হচ্ছে তামাক, বাদামসহ নানা ধরনের ফসল। চলতি মৌসুমে কৃষিজ সেচ ও নৌ চলাচল ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি প্রতি বছর সামান্য বৃষ্টিতে নদীর পানি ফেঁপে উঠে বন্যা সৃষ্টি আশঙ্কা করা হচ্ছে। নদীর নাব্য হ্রাস হয়ে চর জেগে উঠার পেছনে ব্যাপক হারে পাহাড় কাটা, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পাহাড় ও ঝিরি খুঁড়ে অবাধে পাথর উত্তোলন ও নদীর তীরে ব্যাপক হারে তামাক চাষকেই দায়ী করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থল পার্বত্য বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা সদর থেকে ৬০-৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী থানচি উপজেলার একটি পাহাডের পাদদেশে। লামা-আলীকদম উপজেলায় সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল মূলত এ নদীর মাধ্যমেই। উৎপত্তিস্থলে থেকে সর্পিল গতিতে একেবেঁকে নদীটি পশ্চিমমুখী বাঁক নিয়ে আলীকদম-লামা ও কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। বান্দরবান পাহাডি জেলা হলেও লামা-আলীকদমের জায়গা কিছুটা সমতল। এখানে ব্যাপকভাবে কৃষি কাজ হয়।
এছাড়া এই দু উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যাতায়াতের জন্য সড়ক পথ না থাকায় স্থানীয়দের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম মাতামুহুরী নদীপথ। পাহাড়ের তীরবর্তী হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে ভারী বর্ষণে পাহাড থেকে মাটি ক্ষয় হয়ে মাতামুহুরী নদীতে পড়ে। ফলে নদীতে বালু, পলি ও এঁটেল মাটির স্তর জমে নাব্য হ্রাস পায়। এছাড়া নদীর দু পাড়ে ব্যাপক হারে তামাক চাষের কারণে মাটি ক্ষয় হয়ে দিন দিন নদী তলদেশ ভরে গিয়ে নাব্য কমে যাচ্ছে।
এছাড়া দুপাড়ের অংশ বিশেষ দখলে নিচ্ছে স্থানীয়রা। এতে করে মাতামুহুরী নদীর বুকে স্থানে স্থানে অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে উঠে নৌযান চলাচল, কাঠ ও বাঁশ পরিবহনে বিঘ্ন ঘটছে। পাশাপাশি চাষাবাদের জন্য মাতামুহুরী নদীর উপর সেচ কাজের নির্ভরশীল হলেও আসন্ন ও চলতি মৌসুমে পানি সংকটের আশংকা করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
নদীর পানি কমে যাওয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছও বিলুপ্ত হতে চলেছে। অথচ নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তেমন উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নদীর যৌবন ফিরে পেতে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বৃক্ষ নিধন, পাহাড় ও ঝিরি খুঁড়ে অবাধে পাথর উত্তোলন ও নদীর তীরে ব্যাপক হারে তামাক চাষ বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী এম রুহুল আমিন।
নদী পয়েন্টের বাজার ঘাট ইজারাদাররা জানান, নদীর বুকে যে ভাবে চর জেগে উঠছে তাতে মালামাল পরিবহণে বিঘ্ন ঘটছে। মাতামুহুরী নদীর নাব্য পুনরুদ্ধারে আলীকদম সদর থেকে লামা পৌর এলাকার শেষ সীমানা পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে ড্রেজিং জরুরি বলেও তারা মনে করেন।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া ও আবদুল আজিজ বলেন, ১৯৮০-৮৫ সালে মাতামুহুরী নদীর গভীরতা ছিল ৩০-৪০ ফুট। প্রস্থ ছিল ৫০০-৭০০ ফুট। কিন্তু নদীর সাথে সংযোগকারী ঝিরি ও খালগুলি থেকে নির্বিচারে পাথর আহরণের কারণে একদিকে যেমন পানির উৎস হারিয়ে গেছে অপরদিকে ঝিরির পলিতে ভরাট হচ্ছে নদী। বিগত বছরে ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা ১৫-২০ ফুটে চলে এসেছে। দু’পাড় ভেঙ্গে গিয়ে নদীর প্রস্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০০-১২০০ ফুটে। সামান্য বৃষ্টিতে পানি ফেপে উঠে তলিয়ে যায় তীরবর্তী লামা পৌর শহর ও আলীকদম উপজেলা সদর এলাকা। এই নদীতে বর্তমানে নৌযান চলাচল করছে মাত্র ৩-৪ ফুট পানির মধ্যে দিয়ে। কোন কোন অংশে আরও কম।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে লামা-আলীকদম ও চকরিয়া উপজেলার কয়েক হাজার চাষী মাতামুহুরী নদীর পানি দিয়ে জমিতে সেচ দেন। প্রতি মৌসুমে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাষীরা রবিশস্য ও বোরো চাষে নির্দিষ্ট স্থান থেকে আগের মত পানি পাচ্ছে না। চাষের পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে খরচ দ্বিগুণ হচ্ছে। ফলে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। তাছাড়া এ নদী পথে কাঠ, বাঁশ ও বিভিন্ন মালামাল দেশের বিভিন্ন স্থানে আনা-নেয়া হয় খুব কম খরচে। এখন এ পথে আনা-নেয়া বন্ধ হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে লামা বনবিভাগের বাঁশ পরিবহনে বিপাকে পড়বেন ইজারাদারগণ। নদী দিয়ে বাঁশ পরিবহন করে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা রাজস্ব পাচ্ছে সরকারের বনবিভাগ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ।
মাতামুহুরী নদীর নাব্য হ্রাস পেয়ে অসংখ্য চর জেগে উঠার কথা স্বীকার করে লামা উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী জানায়, এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে লামা, আলীকদম ও চকরিয়া উপজেলার দু’সহস্রাধিক জেলে পরিবার। গত কয়েক বছরে ব্যাপকহারে নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ায় মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং কৃষিজ সেচ কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, নাব্য কমার কারণে চলতি বর্ষায় প্রবল বৃষ্টির কারণে নদীর পানি ফেঁপে উঠে লামা ও আলীকদম উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। এতে স্থানীয়দের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফ জামান বলেন, যে কোনো নদী ড্রেজিং করার আগে জরিপ করতে হয়। এ নদীটি এখনো জরিপের আওতায় আসেনি। তিনি বলেন, এলাকার জনগণের চাহিদা থাকলে অবশ্যই মাতমুহুরী নদী জরিপপূর্বক ড্রেজিংয়ের আওতায় আনা হবে। পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কথায়, “এই ঘটনায় পাঁচ জন বিজেপি নেতার নাম জড়িয়েছে। অভিযুক্তেরা দোষী প্রমাণিত হলে তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। ”