সোমবার, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ইং ১লা ফাল্গুন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

গ্রামে ইয়াবা পৌঁছায় কবুতর

AmaderBrahmanbaria.COM
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭

নিউজ ডেস্ক : মরণ নেশা ইয়াবার ব্যবসায় কবুতর ব্যবহার করার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। শহর থেকে গ্রামে এখন ইয়াবা পাচারে কবুতর ব্যবহার হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যতই তৎপর হচ্ছে তারাও ব্যবসা নিরাপদ করতে নিত্যনতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে। আধুনিক ডাক-ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আগে প্রাচীন রাজা-বাদশারা যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কবুতরকে ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় গুপ্তচর হিসেবে কবুতরকে ব্যবহার করার অভিযোগে কবুতর আটকও করেছে ভারতের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

কিন্তু সময়ের বিবর্তনে যোগাযোগব্যবস্থায় এখন আর কবুতর ব্যবহার না করা হলেও এ মাধ্যমকে লুফে নিয়েছে দেশের মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে শান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত কবুতরকে ব্যবহার করছে। যেসব মাদকদ্রব্যের বাজারমূল্য বেশি সেসব মাদক অভিনব পন্থায় পাচার করছে। রাজধানীর গুলিস্তান কবুতরের মার্কেট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা ও টঙ্গীর কবুতর হাটের ব্যবসায়ী ছাড়াও সংশ্লিষ্ট নানা সূত্রে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কবুতরকে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় নিয়ে প্রশিক্ষিত কবুতরের উরু ও পাখায় বিশেষ কৌশলে (কর্ক দিয়ে) ইয়াবার প্যাকেট, হেরোইন ও মারিজুয়ানার ছোট্ট প্যাকেট বেঁধে ছেড়ে দেয়া হয়। কবুতরটি তার মালিকের কাছে বা কবুতরের বাসায় (গন্তব্যে) পৌঁছার পর প্যাকেটটি খুলে নেয়া হয়। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার সম্ভাবনা যেমন কম তেমনি পাচারও থাকছে নিরাপদ। গুলিস্তানের ঠাটারিবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কবুতর পোষা এখনো অনেকেরই প্রিয় একটি শখ। শখ মেটাতে সৌখিন মানুষেরা কবুতরের হাটগুলো চষে বেড়ান। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

এসব কবুতরের হাটে হোমা, লাখা, গিরিবাজ, মিহিরবাজ, সিরাজী, গিয়াছুল্লী, শাটিং, কিং, শর্ট এঞ্জেল, গররা, পোয়ার্টার, রেসার, কিলা, র‌্যাগস, বার্মিজ, বোম্বেসহ বিভিন্ন নাম ও জাতের কবুতর দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে কোনোটি দেখতে বড়, কোনোটি সুন্দর, কিন্তু উড়তে পারে না, আবার কোনো কবুতর আকাশে খেলা করতে পারে। তবে বাজারে সবচেয়ে দামি ‘হোমা’ জাতের কবুতর। এরা বেশি সময় উড়তে পারে। এদের যত দূরেই ছেড়ে দেওয়া হোক না কেন, নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে আসতে সক্ষম। এই প্রজাতির এক জোড়া কবুতরের দাম লাখ টাকারও বেশি।

শ্যামপুরের মাহবুবে জামান নামে এক কবুতর ব্যবসায়ী আমার সংবাদকে জানান, হোমা জাতের কবুতর একশ থেকে দুইশ গ্রাম ওজনের মালামাল বহন করতে পারে। তিনি এক জোড়া রেসার হোমা কবুতর নারায়ণগঞ্জের বন্দর থেকে ছেড়ে দেন। সেখান থেকে মাত্র ৮ মিনিটের মধ্যেই তার বাসায় কবুতর দুটি ফিরে আসে বলে সেখান থেকে তাকে মোবাইল ফোনে জানানো হয়। এ প্রজাতির এক জোড়া কবুতরের দাম ২ লাখ ১০ হাজার টাকা বলে তিনি জানিয়েছেন।

জনৈকা মহিলা কবুতর ব্যবসায়ী জানান, আগে মানুষ কবুতর পালন করতেন শখের জন্য। এখন করেন লাখ লাখ টাকা ব্যবসা করার নেশায়। অধিকাংশ কবুতর পালনের জায়গা বিভিন্ন বাড়ির ছাদ। আড়ালে নিরাপদে মাদক ব্যবসা করা। শুধু তাই নয়, যারা কবুতর পালন করেন, তারা এখন কবুতরকেও নেশার জিনিস খাওয়াচ্ছেন। ‘কেপ্টাগন’ নামক একজাতীয় ট্যাবলেট কবুতরকে খাওয়ানো হচ্ছে। ফলে ওইসব কবুতর যেখানেই তাকে বিক্রি করা হোক না কেন, এক বছর পর হলেও তারা আগের মালিকের কাছে ফিরে আসবেই। কেরানীগঞ্জের জিনজিরা বাজারের এক কবুতর ব্যবসায়ী প্রতি শুক্রবার ঠাটারি বাজার আসেন। বিক্রি না করেই ইয়াবা বেঁধে কবুতরগুলো ছেড়ে দেন। তার বাড়ির ছাদ থেকে মাদক ব্যবসায়ী ছেলে ইয়াবাগুলো সংগ্রহ করেন। এরপর পুরো কেরানীগঞ্জে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করেন বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে থেকেও ইয়াবা, হেরোইন ও মরফিনজাতীয় মাদক আনার জন্য এসব রেসার কবুতর কিনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কতিপয় মাদক ব্যবসায়ী। এ ধরনের প্রশিক্ষিত কবুতরই লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী এধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সহায়তা করছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের সবগুলো কবুতর হাটে এখন প্রকাশ্যেই হেরোইন, আফিম, ইয়াবাসহ মাদক বিক্রি করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কবুতর দিয়ে হেরোইন, মারিজুয়ানা, আফিম, ইয়াবাসহ সর্বোচ্চ মূল্যের মাদক পাচার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে বিভিন্ন দ্বীপ অঞ্চল থেকে কবুতরের মাধ্যমে মাদক পাচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের টেকনাফ, মিয়ানমার, কক্সবাজারের সীমান্ত অঞ্চল থেকেও কবুতরের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকায় মাদকপাচার করা হচ্ছে। রাজধানীর গুলিস্তান, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের পাগলা বাজারে সবচেয়ে বেশি গিরিবাজ শ্রেণির কবুতর বিক্রি হয়। এ গিরিবাজ কবুতরের ৫০ ধরনের জাত রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে আর্কষণীয় হচ্ছে সবুজগলা ও লালগলার গিরিবাজ। এক হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকায় এসব কবুতর ক্রয় বিক্রয় করা হচ্ছে। আবার এক জোড়া রেসারজাতীয় কবুতরের দাম ৫ লাখ টাকা পর্যন্তও হাঁকা হচ্ছে। আর কিংজাতের কবুতর ১৫-৩০ হাজার টাকায়, জোরালো ডাকের র‌্যাগস কবুতর ২০-৪০ হাজার, মিহিরবাজ ২০-৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ডাক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাচীনকাল থেকে এমন কি মোগল আমলেও চিঠি আদান-প্রদানে কবুতর ব্যবহার করার কথা শুনে আসছি। এখনও তা সম্ভব। তিনি জানান, যশোর, সাতক্ষীরা এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা যদি কবুতরের পা, উরু ও পিঠে মাদক বেঁধে ছেড়ে দেয়, তাহলে ওই কবুতর তার নিজস্ব গন্তব্যে চলে আসতে পারে। এ ধররে কাজ কবুতর দিয়ে করানো হয় বলে আমিও শুনেছি। ভারতীয় মহারাষ্ট্র পুলিশ ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের সন্দেহে ২০১০ সালে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে একটি কবুতর গ্রেফতার করে। কবুতরটিকে পাকিস্তানের সংযুক্ত গুপ্তচর হিসেবে ভারতীয় পুলিশ দাবি করে।

এরপর পুলিশ অফিসিয়ালভাবে জানায়, ‘কবুতরটি পাকিস্তানের হয়ে ভারত থেকে বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে যায়। কবুতরটির আচরণেও গোয়েন্দা ভাব লক্ষ্য করে পুলিশ। এখানেই শেষ নয়, ওই কবুতরটির মেডিকেল টেস্টও করানো হয়। মেডিকেল টেস্ট করে নিশ্চিত করা হয় যে, কবুতরের গায়ে গোয়েন্দা ডিভাইস রয়েছে। এ অপরাধে কবুতরটিকে আটক করে খাঁচায় রাখা হয়। এরপর পাকিস্তানের পক্ষে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে কবুতরটিকে ভারতের সেনা প্রহরায়ও রাখা হয়েছিল।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা আমার সংবাদকে জানান, বিদেশে মাদক ব্যবসায়ীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মাদক পরিবহনের জন্য কবুতর ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও মাদকপাচারে কবুতর ব্যবহার হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে এ পন্থার মাদক পাচারকারীদের গ্রেফতার করতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি। আ/সং