নিউজ ডেস্ক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আকতার জাহান জলির মৃত্যুতে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে। প্রিয় শিক্ষককে হারানোর বেদনায় তারা আহত। সবারই প্রশ্ন আকতার জাহানের মতো ব্যক্তিত্ব কীভাবে নিজেকে শেষ করতে পারেন। সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে পারেন ফেরার দেশে।
প্রিয় মানুষটিকে হারানোর যন্ত্রণা, হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়েছেন। লিখছেন প্রিয় শিক্ষক আকতার জাহান জলিকে নিয়ে। এ অকাল মৃত্যুতে সবাই কতটা শোকাহত, মর্মাহত হয়েছেন তারই জানান দিচ্ছে লেখাগুলো।
রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, আর পারছি না। ম্যাম আমাদের রিপোর্টিং পড়াতেন। শিখিয়েছেন কীভাবে কারো মৃত্যু সংবাদ লিখতে হয়। আজ তারই মৃত্যু নিয়ে লিখতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে তার কক্ষে পাওয়া সুইসাইড নোট নিয়ে। না না। এ সত্য নয়। দুঃস্বপ্ন দেখছি। প্লিজ কেউ বলেন সত্য নয়, স্বপ্ন দেখছি।
আরেক ছাত্র লিখেছেন, লাশকাটা ঘরে ফেলে এসেছি আপনার দেহ। কিন্তু ফেলতে পারিনি আপনার গভীর স্মৃতি। ম্যাম, আপনি প্রচণ্ড স্বার্থপর। হিম ঠাণ্ডায় কেমন করে ঘুমাচ্ছেন। আমরা ঘুমাতে পারছি না। আপনার স্মৃতিগুলো যন্ত্রণায় বিদ্ধ করছে। ম্যাম সবাইতো আপনাকে জানে না। ওরা কত কটুকথা বলবে। আপনার তো এটা প্রাপ্য ছিল না। আপনার মতো মানুষদের এভাবে যেতে হয় না। আপনি বোঝেন না? মায়ের অকাল মৃত্যুতে সন্তানদের অবস্থা কেমন হয়। তখন আমাদের কথা মনে হয়নি? একটুও মিস করেন নি? না জানি কত কষ্ট পেয়ে আমাদের কথা ভুলে চলে যেতে বাধ্য হলেন। ভাবতে পারছি না।
ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছেন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আরাফাত সিদ্দিকী। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে ছুটে গেছেন জুবেরি ভবনে। পরে রাতে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, যার লেখা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্ল্যাকবোর্ডে দেখেছি, ইনকোর্স পরীক্ষার খাতাতে আমার ভুলগুলোর পাশে যিনি সুন্দর করে মন্তব্য লিখতেন, যা দেখে আমি মুগ্ধ হতাম, সেই হাতের লেখা দেখলাম আজ অনেকদিন পর, একটি ‘সুইসাইড নোটে’।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মেহেরুল হাসান সুজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, পরীক্ষার হলে যতোবারই ম্যাডাম পরিদর্শক হিসেবে থাকতেন, অতিরিক্ত খাতা আনতে গেলেই বলতেন, ‘মেহেরুল, তুমি যেন এখন কোন কাগজে কাজ করছো?’ ম্যাডাম হেসে বলতেন, ‘ও, ভুলে যাই শুধু।’ এমন অসংখ্য স্মৃতি আকতার জাহান ম্যাডামের সঙ্গে।
বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব আলম লিখেছেন, আপনি তো অনেক যত্ন করেই রিপোর্টিং শেখাতেন ম্যাম; তারপরও কেন আজ আপনার রিপোর্ট লিখতে গিয়ে হাতটা কাঁপছিল, কেন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল? রিপোর্টিং শিখিয়ে কী আজ সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা নিলেন আপনি? পরীক্ষার হলে তো এসে বলতেন, ‘মাহবুব, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে।’
প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে তার সাবেক-বর্তমানের অগণিত শিক্ষার্থী রাতভর ফেসবুকে এমনই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাজশাহীতে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরাও অধ্যাপক আকতার জাহানকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আকতার জাহানের এমন চলে যাওয়া মানতে পারছেন না তারা। এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনায় যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলি। শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে কক্ষের ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কক্ষটির দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল। ওই কক্ষে আকতার জাহানের হাতে লেখা একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কয়েক বছর আগে একই বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে আকতার জাহানের। স্বামী পরে বিভাগেরই আরেক ছাত্রী ও বর্তমান শিক্ষক সোমা দেবকে বিয়ে করে ঘরসংসার করলেও আকতার জাহান আর সেদিকে যাননি। থাকতেন একা। একমাত্র ছেলে ঢাকায় থাকেন। অন্যদিকে জুবেরি ভবনের এই কক্ষে একাই থাকতেন আকতার জাহান।
সুইসাইড নোটে তিনি তার সাবেক স্বামীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি লিখেছেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম। সোয়াদকে (ছেলে) যেন ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে- সে যে কোনো সময় সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।
শিক্ষিকা আকতার জাহানকে মানসিক পীড়ন করতেন তার সাবেক স্বামী। এটাই এখন সবার সামনে এসেছে। আকতার জাহানের লাশ এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। দেহটি তার রাজশাহী মেডিকেল কলেজকে উৎসর্গ করেছেন মৃত্যুর আগে।বিডি প্রতিদিন