মহিউদ্দিন ত্রিশ দেশ হেঁটে হজ করেছিলেন
ডেস্ক রিপোর্ট ।। ‘১৯৬৮ সালে হজ করার উদ্দেশ্যে হেঁটে দিনাজপুর থেকে যাত্রা শুরু করি। দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে প্রথমে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে যাই। সেখানে গিয়ে হেঁটে হজ পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করি। তৎকালীন কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা আলী আকবর হেঁটে যেতে ইচ্ছুক অন্য ১১ জন হজযাত্রীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। শুরু হয় ১২ জনের হজযাত্রা। চট্টগ্রাম দিয়ে ভারত হয়ে পাকিস্তানের করাচির মক্কি মসজিদে গিয়ে যাত্রা বিরতি দিয়ে সৌদি আরবের ভিসার জন্য আবেদন করি।
আট দিন পর সৌদি ভিসা হাতে পাই। পাসপোর্ট ও ভিসা করতে খরচ হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। এরপর পাকিস্তানের নোকঠি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইরানের তেহরান হয়ে ইরাকের বাগদাদ ও কারবালা দিয়ে মিসর পাড়ি দিয়ে সৌদি আরব পৌঁছি। পথে ফেরাউনের মরদেহ দেখার ইচ্ছাও পূর্ণ করে দেন মহান আল্লাহপাক। সৌদি আরবে গিয়ে হজ পালন শেষে আল্লাহর রাস্তার ধুলো পায়ে লাগিয়ে হেঁটে হেঁটেই ফিরে আসি নিজ পরিবারের কাছে। এ সময় আমি মোট ৩০টি দেশ পাড়ি দিয়েছি।’
কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের মহিউদ্দিন। এই মানুষটিই বাংলাদেশ থেকে হেঁটে সৌদি আরব গিয়ে পবিত্র হজ পালন করেছেন। তিনি দিনাজপুর সদর উপজেলার রামসাগর দীঘিপাড়া গ্রামের মৃত ইজার পণ্ডিত ও মমিরন নেছার ছেলে। সেই সঙ্গে তিনি জাতীয় উদ্যানের বায়তুল আকসা জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। বর্তমানে তার দেখা পাওয়া যাবে দিনাজপুরের রামসাগর জাতীয় উদ্যানে ঢুকে পশ্চিমের রাস্তা ধরে বাঁয়ে ঘুরে কিছু দূর যেতেই চোখে পড়বে রামসাগরের পাষাণবাঁধা ঘাট আর পশ্চিম দিকে দেখা যাবে একটি মসজিদ। সেখানেই চোখে পড়বে একেবারে বৃদ্ধ একজন মানুষ, যিনি রামসাগরে আসা সব পর্যটককে আহ্বান জানান রামসাগর দীঘিপাড়া হাফেজিয়া ক্বারিয়ানা মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করার জন্য। অদম্য এই মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৩ সালে। বর্তমানে তার বয়স ১০৬ বছর।
মহিউদ্দিন আরো বলেন, হেঁটে হজ করতে যেতে সময় লেগেছিল আঠারো মাস। এ আঠারো মাসে পাড়ি দিয়েছি কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ। এ সময় আমি সফর করেছি ৩০টি দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান থেকে ঘুরে আসার অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যাবে না। এভাবে হজ পালনে যেতে পারার কারণে সবসময় আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। আরো একটি বিষয় হচ্ছে, আমি যখন হজে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম, তখন আমাদের অনেক অভাব-অনটন ছিল। তারপরও আমার সহধর্মিণী আবেদা বেগম সবসময় আমার ইচ্ছা পূরণের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। এ কারণে আমি হজ করে আসতে পেরেছি। এজন্য আমি স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ।
মহিউদ্দিন বলেন, পাসপোর্ট ও ভিসা করতে খরচ হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। পুরো হজে এই টাকাটা আমার খরচ হয়। আমার কাছে আরো ১ হাজার ৮০০ টাকা ছিল। সেই টাকা আর খরচ করতে হয়নি। আমরা মোট ১২ জন হজযাত্রী ছিলাম। আমরা যেখানেই খেতে গেছি, মানুষ আমাদের ভালোবেসে খেতে দিয়েছেন। কেউ আমাদের থেকে টাকা নেয়নি। এ কারণে আমাদের বেশি খরচ হয়নি। হাজী মো. মহিউদ্দিন স্ত্রীকে নিয়ে এখন বেশ ভালো আছেন। চার মেয়ে ও দুই ছেলে সবার বিয়ে হয়ে গেছে। পরিবারেও তেমন অভাব নেই বললে চলে। অবশ্য বয়সের কারণে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি কিছুটা কমে গেছে। লাঠি ছাড়া ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কিন্তু হেঁটে হজে যাওয়ার কোনো স্মৃতিই তিনি ভুলে যাননি। কেউ জিজ্ঞেস করলেই মুখ থেকে ঝরতে থাকে কথার ফুলঝুরি। সবার কাছে বলতে চান সেসব দিনের কথা। সর্বোপরি তিনি সবাইকে একবার হলেও আল্লাহর ঘর তওয়াফ করার কথা বলেন।