মৃগীরোগ বা খিচুনীর ১১টি কারণ ও ৯টি চিকিৎসা জেনে নিন
অসুস্থতা কারোই কাম্য নয়। অসুস্থত থাকার চেয়ে সুস্থ থাকা অনেক ভালো। স্বাস্থ্যের মূল নীতি হল, স্বাস্থ্যকর খাবার, সুস্থত থাকা। কিছু কিছু বিষয় আছে যাদেরকে খিচুনীর ত্বরান্বিতকারী বিষয় প্রেসিপিটেটিং বা ট্রিগার ফ্যাক্টর বলা হয়। মৃগীরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মস্তিষ্ক যাদের, তাদের ক্ষেত্রে এই ট্রিগার ফ্যাক্টরগুলির উপস্থিতি খিচুনীর উদ্ভব ঘটায়।
যেমন, অনিদ্রা, অ্যালকোহল ও অন্যান্য উদ্দীপক নেশাদ্রব্য, অত্যধিক শারীরিক ও মানসিক অবসাদ, টিভি বা কম্পিউটার স্ক্রীনের কম্পমান আলো, উচ্চ আওয়াজযুক্ত সংগীত বা কোলাহল, গরম পানিতে গোসল ইত্যাদি। তবে, খিচুনী বা মৃগীরোগের জন্য যেসব বিষয়কে দায়ী করা হয় সে সব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো-
খিচুনী বা মৃগীরোগ কি? : মস্তিষ্ক-কোষ বা নিউরনের তাড়িতিক বেগের অস্বাভাবিকতার কারণে যে কোন ধরণের ক্ষণস্থায়ী শারীরিক প্রতিক্রিয়া বা বাহ্যিকলক্ষণকে সিজার বা খিচুনী বলা হয়। বার বার খিচুনী হওয়ার প্রবণতাকে মৃগীরোগ বলা হয়ে থাকে। এপিলেপসি বা মৃগীরোগ স্নায়ুতন্ত্রের একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্রনিক রোগ। যে কোন বয়সে, পুরুষ বা নারীর যে কারো এ রোগ হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খিচুনীর বা মৃগীরোগের প্রকৃত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
১. বংশগত কারণ: বংশে কারো মৃগীরোগ থাকলে ঐ বংশের যে কোন ব্যক্তির মৃগী হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়। দেখা গেছে, ৩০% রোগীর ক্ষেত্রে তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের ফার্স্ট – ডিগ্রি রিলেটিভ মৃগীরোগের ইতিহাস আছে।
২. জ্বর বা ফেব্রাইল কনভালশন: পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অনেক সময় উচ্চ-তাপমাত্রার জ্বরের পর খিচুনী হতে দেখা যায়। একে ফেব্রাইল কনভালশন বলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এই ধরণের খিচুনী পরবর্তীতে মৃগীরোগে রূপ নেয়।
৩. প্রসবকালীন আঘাত: প্রসবের সময় কোন কারণে শিশুর মাথায় আঘাত লাগলে পরবর্তীতে মৃগীরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. মস্তিষ্কের রোগ: ডিজেনারেটিভ রোগ যেমন, আলঝেইমার্স রোগ, ক্রুডজফেল্ড জ্যাকব রোগ প্রভৃতি, প্রদাহজনিত রোগ, যেমন – এনকেফালাইটিস, মেনিনজাইটিস, সেরিব্রাল অ্যাবসেস, করটিকাল ভেনাস থ্রম্বোসিস, নিউরোসিফিলিস প্রভৃতি রোগে খিচুনী হতে পারে। এছাড়া মাল্টিপল স্কে¬রোসিস, হাইড্রোকেফালাস প্রভৃতি রোগের ফলেও খিচুনী দেখা দেয়।
৫. মস্তিষ্কের টিউমার: মস্তিষ্কের কর্টেক্স অংশে টিউমার থাকলে তার ফলে মৃগীরোগ হতে পারে।
৬. মস্তিষ্কে অক্সিজেনের স্বল্পতা: মস্তিষ্কের রক্ত-পরিবাহী নালীর সমস্যা বা অন্য কোন কারণে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলে খিঁচুনী এবং তা থেকে মৃগীরোগ হতে পারে।
৭. মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার: মস্তিষ্কের সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ারের অস্ত্রোপচারের পর ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃগীরোগ হতে পারে।
৮. অতিরিক্ত মাদকাসক্তি: দীর্ঘদিন ধরে যারা অ্যালকোহলে আসক্ত, তাদের মৃগীরোগ হতে পারে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনকালে এবং অ্যালকোহল পান ছেড়ে দেয়ার সময়, উভয় সময়েই খিচুনী হতে পারে।
৯. বিভিন্ন রোগের ওষুধ: বিভিন্ন রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধও খিচুনী সৃষ্টি করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক – যেমন – পেনিসিলিন, আইসোনিয়াজাইড, মেট্রোনিডাজল। অ্যান্টিম্যালেরিয়াল- যেমন, ক্লোরোকুইন, মেফলোকুইন ইত্যাদি।
১০. মানসিক রোগের ওষুধ: ফেনোথায়াজিন, ট্রাইসাইক্লিকস, লিথিয়া, সাইক্লোস্পোরিন, অ্যাম্ফিটামিন প্রভৃতি।
১১. মেটাবলিক ডিসঅর্ডার: বিভিন্ন ধরণের বিপাকীয় ব্যধি বা মেটাবলিক ডিসঅর্ডার থেকে খিচুনী হতে পারে। যেমন- হাইপোক্যালসেমিয়া (রক্তে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া), হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লকোজের পরিমাণ কমে যাওয়া), হাইপোনেট্রেমিয়া (রক্তে সোডিয়াম কমে যাওয়া), হাইপোম্যাগনেসিমিয়া (রক্তে ম্যাগনেসিয়াম কমে যাওয়া), রেনাল ফেইলিওর, লিভার ফেইলিওর প্রভৃতি।
খিঁচুনী হলে প্রাথমিক চিকিৎসা: কাউকে খিচুনীতে আক্রান্ত হতে দেখলে প্রকৃতপক্ষে, খিচুনী চলাকালীন সময়ে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা এবং সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োগ ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না কারোই।
১. অহেতুক ভয়: আমরা অনেকেই খিচুনী দেখলেই অহেতুক ভয় পেয়ে যাই। অহেতুক ভয় পাবেন না কারণ অধিকাংশ খিচুনীই মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
২. টানাটানি বা সরানো চেষ্টা: খিচুনী-আক্রান্ত অবস্থায় রোগীকে সরানোর চেষ্টা করবেন না। বিপদাশংকা রয়েছে এমন জিনিস যেমন আগুন, পানি, ধারালো বস্তু, আসবাবপত্র রোগীর নিকট থেকে সরিয়ে ফেলুন।
৩. মাথায় আঘাত: রোগী দাড়ানো বা চেয়ারে বসা অবস্থায় খিচুনীতে আক্রান্ত হলে তাকে আলতো করে ধরে মেঝেতে শুইয়ে দিন অথবা এমন ব্যবস্থা নিন যাতে রোগী পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত না পায়। রোগীর মাথার নিচে বালিশ বা নরম কোন কাপড় বা ফোম- এ জাতীয় কিছু দিন।
৪. রোগীকে চেপে রাখবেনা: খিচুনী স্বাভাবিকভাবে শেষ হতে দিন। খিচুনী বন্ধ করার জন্য রোগীকে চেপে ধরবেন না। রোগীর মুখে জোর করে আঙুল বা অন্য কিছু ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না। রোগীর জিহ্বায় দাঁত দিয়ে কামড় লাগলেও খিচুনীরত অবস্থায় তা ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি না করাই ভালো।
৫. জামাকাপড় ঢিলে করে দেওয়া: রোগীর গলায় টাই বাধা থাকলে বা বেল্ট পড়া থাকলে তা খুলে দিন। জামাকাপড় ঢিলে করে দিন। রোগীর আশেপাশে ভীড় জমতে দেবেন না।
৬. ঘুমানোর পরিবেশ: খিচুনী শেষ হলে রোগীকে এক পাশে কাত করে শুইয়ে দিন। এবং ঘুমানোর পরিবেশ তৈরি করে দিন। যাতে করে রোগী সাধারণ অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।
৭. শ্বাস-প্রশ্বাস: খিচুনী শেষ হলে রোগীর নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করুন, রোগী ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে কি না সেদিকে দৃষ্টি রাখুন। শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হয় এমন কোন কিছু মুখে বা নাকে থাকলে তা সরিয়ে দিন।
৮. আশ্বস্ত করুন: জ্ঞান ফেরার পর রোগীর কিছু সময়ের জন্য মানসিক বিভ্রম দেখা দেয়, রোগীর পারিপার্শ্বিকের সম্পর্কে জ্ঞান থাকে না। এ সময়টুকু রোগীর পাশেই থাকুন, তাকে আশ্বস্ত করুন। পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় না আসা পর্যন্ত রোগীকে ছেড়ে যাবেন না।
৯. অঙ্গ-ভঙ্গি বর্ণনা: প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে রোগীর কতক্ষণ খিচুনী হয়েছে বা খিচুনীর সময় রোগী কিভাবে অঙ্গ-ভঙ্গি ও মুখভঙ্গি করেছে তা মনে রাখতে পারলে ভাল। কারণ, চিকিৎসক খিচুনীর সঠিক বর্ণনা শুনতে পেলে রোগের ধরণ নির্ণয়ে সুবিধা হয়। খিচুনী যদি ৫ মিনিটের বেশী স্থায়ী হয়, কিংবা রোগীর একবার খিচুনীর পর জ্ঞান ফেরার আগেই দ্বিতীয় খিচুনী হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করুন বা চিকিৎসককে দেখানোর ব্যবস্থা করুন।
নিজের প্রতি যত্ন নিন। পরিবারের সবার প্রতি যত্ন নিন সুস্থ ও সতেজ থাকুন। যথেষ্ট বিশ্রাম এবং ইতিবাচক চিন্তা করুন। আমরা চাইলেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এগুলোকে একত্রিত করে সুস্থ থাকতে পারি।