বুধবার, ১০ই অক্টোবর, ২০১৮ ইং ২৫শে আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

যে দেশের প্রেসিডেন্ট ৪ জন

ডেস্ক রিপোর্ট।। কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ৪ জন, এমন কথা খুব কম লোকই শুনেছেন। অবাক করার মতো ব্যাপার হলেও তথ্য কিন্তু একেবারেই নির্ভেজাল। পৃথিবীর মানচিত্রে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় নামে একটি দেশ আছে যার প্রেসিডেন্ট চার জন। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাসের দেশটি বসনিয়া নামেই বেশি পরিচিত। সেই দেশটিতে আজ রোববার ভোট হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, বসনিয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল নির্বাচনের দেশ।

জাতিগত বিভক্তি, রাজনৈতিক বিভেদ, জটিল প্রশাসনিক কাঠামো ও ক্ষমতাকে ঘিরে পৃথক সরকারব্যবস্থার লড়াই—এমন সব জটিল হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে নেতা নির্বাচন হয় সেখানে।

বলকান উপদ্বীপে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ত্রিভুজ আকৃতির। বসনিয়া অঞ্চলটি উত্তরে পাহাড় ও গভীর বনবেষ্টিত। বিশাল এলাকাজুড়ে অমসৃণ ও সমতল কৃষিভূমির হার্জেগোভিনা অঞ্চলটি দক্ষিণে। এর সংকীর্ণ উপকূল। দেশটির আয়তন ৫১ হাজার ১২৯ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ৩৫ লাখ ২৬৩৬ জন। রাজধানীর সারায়েভো। দেশটির মুদ্রার নাম মার্কা।

অন্য দেশের মতো বসনিয়ায় একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন না। বসনীয়, সার্ব ও ক্রোয়েট—এই তিন জাতির সমন্বিত প্রেসিডেন্সি পর্ষদ রয়েছে সেখানে। প্রেসিডেন্সি পর্ষদের নেতৃত্বে বা চেয়ারম্যান পদে আট মাস পরপর পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসে।

প্রেসিডেন্সি পর্ষদে বর্তমানে রয়েছেন এসডিএ দলের বাকির ইজেৎবেগোচ (বসনীয়), পিডিপি দলের ম্লাদেন ইভানিচ (সার্ব) ও এইচডিজেড বিহ দলের দ্রাগন চোভিচ (ক্রোয়েট)। ১৭ মার্চ থেকে এ পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বাকির ইজেৎবেগোচ। এর বাইরে রিপাবলিকা স্রেপ্সকার জন্য পৃথক প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। এই অংশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম মিলোরাদ দোদিক।

দেশটিতে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালে। সরকারের মেয়াদ চার বছর।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় দুটি স্বতন্ত্র পক্ষ রয়েছে। একটি দ্য ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, যেটিতে মুসলিম বসনিয়াক ও ক্রোয়েটদের আধিপত্য বেশি। অপরটি হচ্ছে সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকা। দেশটির পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। দ্য হাউস অব পিপলস এবং দ্য হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ।

হাউস অব পিপলসে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। এর দুই–তৃতীয়াংশ ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকার। অর্থাৎ বসনিয়াক (বসনিয়ার মুসলিম), ক্রোয়েট ও সার্বদের পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন এতে।

হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রয়েছেন ৪২ জন সদস্য। এর দুই-তৃতীয়াংশ ফেডারেশন থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকা থেকে ভোটারদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এর বাইরে দুই অংশের আলাদা প্রেসিডেন্ট, সরকার, সংসদ, পুলিশ ও পৃথক কর্তৃপক্ষ রয়েছে।

সব মিলিয়ে দেশটিতে চারজন প্রেসিডেন্ট, পাঁচটি পার্লামেন্টারি হাউস এবং ১০টি ক্যানটন অ্যাসেম্বলি (শাসনতান্ত্রিক বিভাগ) রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ভোটাররা তিন সদস্যের প্রেসিডেন্সি পর্ষদ ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত করে। ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কথিত দুই স্বতন্ত্র পক্ষের এই সরকার গঠন হয়।

সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকার (আরএস) ভোটাররা তাদের একজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি এমপিদের নির্বাচিত করে। এই অংশের রাজধানীর নাম বানজা লুকা।

আর মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশন তাদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের জন্য দুজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশনের ১০টি ক্যানটনের জন্যও ভোটাররা ভোট দিয়ে থাকে।

এত জটিল হিসাব–নিকাশের পর যে–কারও মাথায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে তাহলে বসনিয়ার নেতৃত্ব কে দেন? এর উত্তরও এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ, রাজস্ববিষয়ক নীতি প্রণয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনীতির বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এর চেয়ে দুটি স্বতন্ত্র অংশই তুলনামূলক বেশি কেন্দ্রীভূত। তাদের আলাদা পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে।

দুই স্বতন্ত্র অংশের বিভেদ দেশটির শাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় বারবার। বসনিয়াক বা মুসলিমরা চায় কেন্দ্র শক্তিশালী হোক। অন্যদিকে, সার্বরা কোনো অবস্থায় স্বতন্ত্র শাসন সমর্পণ করতে রাজি নয়।

আর ক্রোয়েটদের মধ্যে বিভক্তি আরও বেশি। তাঁদের অনেকে আশা করেন, ক্রোয়েটদেরও স্বতন্ত্র শাসন তৈরি হবে।

মেদবহুল আমলাতন্ত্র দেশটিকে আরও অকার্যকর করে তুলছে। দেশটিতে ১৮০ জন মন্ত্রী আছেন। অর্থাৎ ২০ হাজার লোকের জন্য মন্ত্রী একজন।

দেশটির আয়তনের সঙ্গে যদি জার্মানির তুলনা করা যায়, তাহলে এ সংখ্যা অনুসারে জার্মানির মন্ত্রী থাকা উচিত চার হাজার। দেশটিতে সরকারি কর্মচারী রয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, দেশটির রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে।

বিশ্লেষকদের মতে, ডেটন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বসনিয়ায় রক্তগঙ্গা বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে দেশটির একেবারে হাত পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে বসনিয়ার। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাবি, নানা সরকারের দেশটিকে ‘একটি কণ্ঠে কথা বলতে পারার’ উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যদিও বিষয়টি প্রায় দুঃসাধ্য।

স্বতন্ত্র সরকার রিপাবলিকা স্রেপ্সকার প্রেসিডেন্ট মিলোরাদ দোদিক বরাবরই বসনিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। যুদ্ধ–পরবর্তী বসনিয়া তাঁর মতে একটি ‘ব্যর্থ ধারণা’।

সূত্র: বিবিসি।