সংকুচিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার: নতুন গন্তব্য খোঁজার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
নিউজ ডেস্ক : দর্জির কাজ নিয়ে পাঁচ বছর আগে ওমান গিয়েছিলেন শাহিন। কিন্তু,গিয়ে দেখেন বেতন খুবই কম। সেখান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জেলে ছিলেন ২০ দিন। তারপর সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউটপাশ দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাকে। শাহিন বলেন, ‘২ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ওমান গিয়ে দেখি বেতন মাত্র ১০০ ওমানি রিয়াল। বাংলাদেশি টাকায় হয় মাত্র ২১ হাজার ৮০০ টাকা। আমার খরচের টাকা কয়দিনে ফেরত আনবো? তাই দুবাই যেতে চাইছিলাম কিন্তু পারি নাই। ২০ দিন জেল খেটে দেশে ফেরত আসছি।’ না বুঝে বা দালালদের প্ররোচনায় ‘ফ্রি ভিসায়’ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে এমন স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা ঘটছে অহরহ।আবার আগে বৈধভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে কাজকর্ম করছিলেন, কিন্তু দেশগুলোতে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন এমন শ্রমিকের সংখ্যাও এখন কম নয়।
শাহিনকে যখন দেশে ফেরত পাঠানো হয় তখন তার সঙ্গে ওমান থেকে ফিরে আসেন আরও ৪০ বাংলাদেশি শ্রমিক।চাকরি হারানোসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হন তারা। শুধু ওমান নয়, একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি থেকে ফেরত পাঠানো হয় ১৫ জনকে,সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয় ৬২ জনকে। সুদান থেকেও ফিরে আসেন আরও ৮ জন। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য হলেও সেখান থেকে শ্রমিকদের ফিরে আসার এই হার প্রতিদিন বাড়ছে। ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়,সর্বশেষ ৩ অক্টোবর সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন অন্তত ৩০০ শ্রমিক বলে জানা যায়। আর দেশে ফিরে তারা বলেছেন, আরও ৫০০-৭০০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফেরার জন্য রয়েছেন অপেক্ষমাণ।
এভাবেই শাহিনের মতো ‘ফ্রি ভিসার’ খপ্পরে পড়ে স্বপ্ন পূরণের আশায় বিদেশ গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে অসংখ্য বাংলাদেশি। এদেরকে আবার অনেকটা বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসতে হয় শূন্য হাতে। প্রতিদিনই তারা ফেরত আসছেন। বিশ্বের ১৫৮ টি দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া হলেও সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু এই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, ওমান, লেবানন, জর্ডান, কাতার, কুয়েত থেকে ইদানিংকালে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ফেরত আসছে। তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে এখন মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসনের হার কমতে শুরু করেছে। এদিকে,সৌদির নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে ১২টি সেক্টরকে সৌদিকরণের ঘোষণায় গত ১৫ মাসে ৭ লাখ ২০০ জন প্রবাসী শ্রমিক সে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। সৌদি আরব সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী,শুধু ২০১৭ সালেই সৌদি আরব ছেড়ে গেছেন ৪ লাখ ৬৬ হাজার প্রবাসী শ্রমিক। এছাড়া বিগত তিন মাসে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ জন শ্রমিক শ্রমবাজার ত্যাগ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানিতে সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং নানাবিধ সামাজিক সমস্যার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানি দিন দিন কমছে। এর পাশাপাশি তেলের দাম নিম্নমুখী হওয়া, কন্সট্রাকশন খাতে চাকরির সুযোগ কমে যাওয়া, ভিসা ট্রেডিং এবং স্থানীয়দের কাজে সম্পৃক্ততার উদ্যোগ নেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য একটি অশনি সংকেত নিয়ে আসছে বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে,সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত আছে। এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে ধারণা করা যাচ্ছে সরকারের এবছর ১২ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য যাচাই করে দেখা যায় ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে গমনের হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সৌদি আরব
সৌদি আরবের শ্রমবাজার দীর্ঘ সাত বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে আবারও চালু হয়। এরপর ২০১৬ সৌদি আরবে যায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৩ জন শ্রমিক। এরপর সবচেয়ে বেশি শ্রমিক যায় ২০১৭ সালে, যার সংখ্যা ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন। তবে ২০১৭ সালের সঙ্গে ২০১৮ সালের প্রথম ৯ মাসের শ্রমিক পাঠানোর হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বছর দেশটিতে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রথম ৮ মাসে যেখানে শ্রমিক গিয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৬০২ জন সেখানে ২০১৮ সালের প্রথম ৮ মাসে পাঠানো হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৯ জন শ্রমিক। ২০১৭ সালে দেশটিতে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জনের।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
২০০৮ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এর সংখ্যা ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন। সর্বশেষ ২০১২ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন কর্মী দেশটিতে যায়। এরপর থেকে নানা কারণে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর হার কমে যেতে থাকে। আরব আমিরাত সরকারের নিষেধাজ্ঞার ফলে ২০১৩ সাল থেকে দেশটিতে কর্মী যাওয়া একেবারেই কমে গেছ। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রথম ৮ মাসে দেশটিতে ২ হাজার ৯৬২ জন শ্রমিক গেলেও ২০১৮ সালের একই সময়ে গিয়েছে ২ হাজার ১৬ জন। আর দেশটিতে ২০১৭ সালে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ১৩৫ জনের।
কুয়েত
যুদ্ধ বিধ্বস্ত কুয়েত থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রথম দেশে ফিরতে বাধ্য হয় ১৯৯০ সালে ইরাকের আগ্রাসনের সময়ে। এরপর দ্বিতীয় দফায় ফিরতে বাধ্য হয় ২০০৩ সালে ইরাকের আরেক দফা দখল ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর হামলার সময়ে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত কুয়েতে এরপর শ্রমবাজার অল্প বিস্তর সৃষ্টি হলেও নিষেধাজ্ঞাও এসেছে দফায় দফায়। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা আসে ২০০৭ সালে। এরপর দেশটিতে লোক যাওয়ার হার একেবারেই কমে যায়। তবে ২০১৪ সালের শেষ দিকে আবারও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী গিয়েছে দেশটিতে। এবছরের প্রথম ৮ মাসের সঙ্গে গত বছরের প্রথম ৮ মাসের তুলনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩৫ হাজার ৪৫২ জন শ্রমিক গিয়েছে কুয়েতে। ২০১৮ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ২৪ হাজার ৫১৬ জন। ২০১৭ সালে দেশটিতে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে ৪৯ হাজার ৬০৪ জনের।
এধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায় কাতার, লেবানন, জর্ডান, বাহরাইনের ক্ষেত্রেও। পরিসংখ্যান বলছে এসব দেশে মানুষ শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক যাওয়ার হারও কমে গেছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক শ্রমবাজারের পাশাপাশি এখন নতুন শ্রমবাজার খোঁজার বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক জনশক্তি রফতানির চেয়ে বেশি জরুরি জনশক্তির মান বজায় রাখা বেশি জরুরি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামও বলেন, নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত আছে। জাপান ও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বাজার অনেকদিন ধরেই বাড়ছে না। ২০১৭ সালে রেকর্ড পরিমাণ লোক যাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল সৌদি আরব আর মালয়েশিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার একটা বড় কারণ হলো জ্বালানি তেল। তাদের তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে বড় বড় কন্সট্রাকশন কোম্পানির কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধাবস্থা, বিশেষ করে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাকে—সে কারণেও কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানো কমে গেছে। সৌদি আরবে প্রচুর লোক গত বছর গেলেও এদের বেশিরভাগই গিয়েছে তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসা’তে। এই প্রক্রিয়ায় গিয়ে তারা দেখেছে কাজ নাই বা কাজের তুলনায় বেতন সন্তোষজনক নয়। এ কারণে আবার অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফেরত আসা শুরু করেছে। কাজেই আমি মনে করি এ বছর কমবে জনশক্তি রফতানি, এর কারণ হচ্ছে আমাদের বিকল্প বাজার খুঁজে না পাওয়া।
শরিফুল হাসান আরও বলেন, বলা হয় ১৫৮ টি দেশে বাংলাদেশের কর্মীরা যায়, কিন্তু দিন শেষে আমাদের কর্মী যাওয়া কিন্তু ৭ থেকে ৮টি মার্কেটেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে আমাদের বিকল্প বাজার কখনোই হয়নি। দক্ষ লোকজন তৈরি করতে পারিনি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন,‘গণহারে বিদেশে জনশক্তি না পাঠিয়ে সংখ্যার চেয়ে গুণগত দিকটা দেখা প্রয়োজন। শুধু অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে না গিয়ে আমাদের দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রতি জোর দিতে হবে। অনেক দেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা আছে প্রচুর। সংখ্যার চেয়ে গুণগত পরিবর্তন যেটা হওয়া দরকার, তার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।’
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ১৫৮টিরও বেশি দেশে জনশক্তি রফতানি করে বাংলাদেশ। বিএমইটি’র তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বিদেশে। যার ফলশ্রুতিতে দেশে রেমিটেন্স হিসেবে এসেছে প্রায় ১৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে এসেছে সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৭ সালে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে,যার পরিমাণ ১০ লাখেরও বেশি। বাংলাট্রিবিউন