বুধবার, ১০ই অক্টোবর, ২০১৮ ইং ২৫শে আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

কনডেমড সেলে যুগ কাটল, এখন তারা নির্দোষ

নিউজ ডেস্ক : ২০০৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ রোডের ফটিক বাবুর বাড়ির সামনে দুই পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করা হয়। ওই হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ২০০৬ সালে রায়হানুল ইসলাম, মো. জাকির হোসেন ও ওবেদ আলীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামিকে নেওয়া হয় কারাগারের কনডেমড সেলে। তার পর কেটে যায় ১২ বছর। এরই মধ্যে প্রমাণ হয়েছে ওবেদ আলী ও জাকির হোসেন নির্দোষ।

কনডেমড সেলে থাকাকালে চার বছর আগে ক্যানসার ধরা পড়ে ওবেদ আলীর। লড়ছেন মৃত্যু সঙ্গে। আপিল বিভাগ নির্দোষ হিসেবে ঘোষিত রায়ের পর কপি পেতে কেটে যায় ছয় মাস। এ সময়ে আদালত প্রাঙ্গণ, মানবাধিকার কমিশন ও আইনজীবীর কাছে ছোটাছুটি করেছেন ওবেদ আলীর ছেলে শাওন। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার হাতে পান রায়ের কপি। এখন মুক্তির অপেক্ষায় ওবেদ আলী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ওবেদ আলী ও জাকির হোসেন নির্দোষ হওয়ার সংবাদ পান আরও প্রায় ৭ বছর আগে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়ার মধ্য দিয়ে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। বিচার বিলম্বে তাদের কারাবাস দীর্ঘায়িত হতে শুরু করে। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল আপিল বিভাগও হাইকোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখেন।

ওবেদ আলীর ছেলে শেখ আশিকুর রহমান শাওন বলেন, ‘বাবার অবস্থা অনেক খারাপ। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে লিভারেও। কিছুই খেতে পারছেন না। স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে খুলনা সদর হাসপাতালের প্রিজন সেলে। জীবনের শেষ মুহূর্তে কিছুদিন হলেও যেন বাবাকে কাছে পাই, সেজন্য এক মাস ধরে চেষ্টা করেছি। ছয় মাস আগে রায় ঘোষণা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাচ্ছিলাম না। অবশেষে মানবাধিকার কমিশনে গেছি।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ফোন করেছিলেন। এর পর সংশ্লিষ্ট বিচারপতির কাছে দেখা করে কেঁদেছি। বিচারপতি ঘটনা জেনে রায়ের কপি দ্রুত লেখা শেষ করেন। গত বৃহস্পতিবার নির্দোষ ঘোষিত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কপি হাতে পেয়েছি। রায়ের কপি নিম্ন আদালত ও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, দু-একদিনের মধ্যেই বাবা মুক্তি পাবেন।’

শাওন বলেন, ‘বাবাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আমাদের পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বাবাকে যখন কারাগারে নেওয়া হয়, তখন আমার বয়স ১২ বছর। আমার বড় দুটি বোন। বাবার অবর্তমানে তাদের বিয়ে দিতে হয়েছে। দীর্ঘদিন পরিবারের হাল ধরার কেউ ছিল না। এমবিএ পাস করেছি। চাকরি পাইনি। সাজানো মামলার কারণে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি। এখন বাবাকে কারাগার থেকে আনার পর চিকিৎসা করাব কী দিয়ে? কে আমাদের ক্ষতিপূরণ দেবে?

জানার পর বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টের এক বিচারপতি, একজন আইনজীবী ও রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে কথা বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, বিচার বিলম্বের কারণে অনেক মানুষ জীবদ্দশায় বিচার দেখে যেতে পারে না। এটা যেন আর না হয়। বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। রায়ের কপি বের হওয়ার পর যেন বিলম্ব না হয়, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, লোকটা হয়তো আর বাঁচবে না। কিন্তু মৃত্যুর আগে তো সে জেনে গেল, সে নির্দোষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মরে গেলে সে যে নির্দোষ, সেটাও জানতে পারত না। দেশে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু আদালতকে দোষারোপ করলে হবে না। আপিল বিভাগে বর্তমানে চারজন বিচারপতি রয়েছেন। এখন আর দুটি বেঞ্চ বসতে পারে না। কঠিন মামলাগুলোই আপিল বিভাগে যায়। মামলার সংখ্যাও অনেক বেশি। যার কারণে বিলম্ব হয়। এ কারণে মামলাজট কমাতে রাষ্ট্রকে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। পর্যাপ্তসংখ্যক বিচারক নিয়োগ করতে হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এ ধরনের ফাঁসির আসামি আপিল বিভাগ থেকে খালাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটি শর্ট অর্ডার (সংক্ষিপ্ত আদেশ) দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কারণ পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে তো সময় লাগে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, যে কোনো আদেশ বা রায় যেন অতি দ্রুত দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারে কী রায় হবে না হবে, সেটা তো বলা যায় না। বিচার শেষ না হলে বিচার বিভাগের দোষ দেওয়া যাবে না। আবার আসামিরাও দোষী নয়। বিলম্বের কারণে আদালতের বিরুদ্ধে তো ক্ষতিপূরণ মামলা করা যাবে না। বিচার প্রক্রিয়ায় সময় ব্যয় হবে এটাই স্বাভাবিক।

ঘটনাটি দুঃখজনক উল্লেখ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিচার বিলম্বের কারণে এ দুর্ভোগ। বিচারে বিলম্ব কমাতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, আদালত ও আইনজীবীকে আরও তৎপর হতে হবে। আইনজীবী যদি মামলাটি মেনশন করে আদালতের নজরে নিত, তা হলে দুর্ভোগ হয়তো কমত।

দুই পুলিশ কনস্টেবল ফজলুল হক এবং মো. মোতালেবকে হত্যার পরের দিন মামলা হয় সাতক্ষীরা থানায়। মামলার চার্জশিটে ১০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে রায়হানুল ইসলাম ও শোয়েবর আলী কারিগর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। মামলা চলাকালে মামলার এক নম্বর আসামি বদরুজ্জামান মামুন এক রিট করে হাইকোর্টে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করান। যার কারণে নিম্নআদালতে তার বিচার এখনো শেষ হয়নি।

বাকি ৯ আসামির মধ্যে নিম্নআদালত ২০০৬ সালে রায়হানুল ইসলাম, মো. জাকির হোসেন ও ওবেদ আলীকে মৃত্যুদণ্ডেরআদেশ দেন। এ ছাড়া আসামি আব্দুস সোবাহান, মো. সালেক, মো. শাহীন ও মো. মিলনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। আসামি শোয়েবর আলী ও মো. সাদিককে আদালত খালাস দেন। রায়ের পরপরই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামিকে নেওয়া হয় কারাগারের কনডেমড সেলে। নিম্নআদালতের রায়ের পরপরই মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া আসামিরাও আপিল করেন।

২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের শুনানি করে নিম্নআদালতের রায় বাতিল করে সব আসামিকেই খালাস দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতির আবেদন) করে। পরে আপিল বিভাগ আপিলের অনুমতি দেন এবং ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেন। দীর্ঘ শুনানি নিয়ে গত ১১ এপ্রিল আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখেন। দৈ.আ.স