সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ
নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেয়। বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে এসে আট বছরের মাথায় প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকলেও বর্তমানে আলোচিত এই মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, অর্থায়নের উৎস নিশ্চিত না হওয়ায় মূলত এই প্রকল্পটি থেমে গেছে। তবে সোনাদিয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যেখানে কয়লার জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয় বিবেচনাধীন রয়েছে।
দাতাদের সহায়তায় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে (সরকার টু সরকার) এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এজন্য এ প্রকল্পে অন্য দেশের সরকারের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু চীন ও জাপান অর্থায়নের আগ্রহ দেখালেও এক পর্যায়ে সরে যায় তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। তবে আমরা মাতারবাড়ির দিকে নজর দিচ্ছি। সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর করার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়ে থাকে। এ চ্যানেলের গভীরতা কম হওয়ায় এবং কর্ণফুলী নদীর বাঁকের কারণে ১৮৮ মিটারেরও বেশি দীর্ঘ ও ৯ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ জেটিতে আসতে পারে না। এতে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী বড় জাহাজগুলো (মাদার ভেসেল) কুতুবদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের কাছাকাছি নোঙর করে লাইটারেজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে হয়। এতে ব্যয় বেড়ে যায়। অন্যদিকে মংলা সমুদ্রবন্দরটি পশুর নদীর পাশে অবস্থিত। এখানে ৭ মিটার ড্রাফটের জাহাজ নোঙর করতে পারে। প্রস্তাবিত সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দরে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ নোঙর করতে পারবে। আর জোয়ারের সময় পারবে ১৬ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের কোন কাজ হচ্ছে না। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কক্সবাজারের মহেশখালীতে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে কয়লা আনার জন্য একটি বন্দর করা হবে। সেটাকে সম্প্রসারণ করে গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপ দেয়া যায় কিনা সেটি বিবেচনা করছে সরকার। এজন্য জাপান স্টাডি চালাচ্ছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) যুগ্ম-সচিব মামুনুর রহমান খলিলী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেরি হলেও সরকার এটি করবে, এজন্য উদ্যোগও আছে।’ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে ২০০৯ সালে একটি সমীক্ষা চালায় জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক কনসালটেন্ট ইন্টারন্যাশনাল (পিএসআই)। এতে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। সমীক্ষাকারী প্র্রতিষ্ঠান বঙ্গোপসাগরের ৮টি স্থানকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহিৃত করে। স্থানগুলো হলো কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, হিরন পয়েন্ট, পতেঙ্গা, আকরাম পয়েন্ট, মহেশখালী চ্যানেল। তাদের সুপারিশে দেশের পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য কক্সবাজারের সোনাদিয়াকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তারা দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর সীমাবদ্ধতার বিষয়টি পর্যালোচনা করে তিন পর্যায়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করে।
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনায় টানেল, শিল্পপার্ক, ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে ও মহাসড়ক, গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় পর্যটন জোন থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হলে চট্টগ্রাম দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরে উন্নীত হবে।
প্রথম পর্যায়ে বন্দর নির্মাণের জন্য ২ দশমিক ২২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। বন্দর অবকাঠামো ছাড়াও সড়ক ও রেলপথ নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকারকে অতিরিক্ত ৫৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করার সুপারিশ করা হয়।
জানা গেছে, জাপানি এ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ ২০০৯ সালের ২০ অক্টোবর অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। কমিটি প্রতিবেদনটি অনুমোদন করে। একই সঙ্গে অর্থায়নের জন্য দাতা সংস্থা খুঁজতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও কোন দাতা সংস্থাকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি। এতে প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য আবার ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একই কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়।
প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রথম পর্যায়ে দেড় কিলোমিটার লম্বা এবং আধা কিলোমিটার প্রস্থের একটি জেটি নির্মাণ করা হবে। এতে ৫টি কন্টেইনার এবং ৪টি সাধারণ পণ্যবাহী বড় জাহাজে মালামাল উঠানামা করতে পারবে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করার সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০১৬ সাল। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০টি বার্থের কাজ সম্পন্ন করতে ২০৩৫ সাল এবং তৃতীয় পর্যায়ে প্রায় ৩০টি বার্থের কাজ সম্পন্ন করতে ২০৫৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।
২০১০ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন সরকারের সহায়তা চান। পরবর্তীতে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জি জিংপিং ওই বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ সফরকালে সমুদ্রবন্দর স্থাপনে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন। এরপর ২০১০ সালের ২ আগস্ট গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ আর্থিক সহায়তা চেয়ে চীন সরকারকে পত্র দেয়। পত্র পাঠানোর পর ২০১২ সালের মে-জুন মাসে চীন সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের চায়না দূতাবাস ও চায়না মার্চেন্ট হোল্ডিং কোম্পানির প্রতিনিধিরা সমুদ্রবন্দরের সাইট পরিদর্শন করেন।
প্রতিনিধি দল পরিদর্শন শেষে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর ও আশেপাশের এলাকায় শিল্প পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, নক্সা প্রণয়ন, উন্নয়ন, অপারেশন, রাজস্ব আদায়সহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় একটি আধুনিক পোর্ট সিটি স্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মতামত ও অনুমোদনের জন্য পাঠায়। ওই সময় তারা নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও সচিবের সঙ্গেও বৈঠক করেন। কিন্তু প্রকল্পটি দু’দেশের আলোচনা ও চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি হয়নি।
২০১৪ সালের জুনে প্রধানন্ত্রী শেখ হসিনার চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা হয়নি। এরপর এ প্রকল্পে জার্মানির সম্পৃক্ত হওয়ার আশ্বাসও শেষ পর্যন্ত আশ্বাস হয়েই থেকেছে। আরব আমিরাত এ প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছিল বলেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছিল।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ২০১২ সালে এসে কর্তৃপক্ষ আইন অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়ন করে মতামতের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এরপর ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি ‘সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর আর আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়নি।