ওষুধের জন্য বছরে মাথাপিছু বরাদ্দ ৪৯ টাকা!
---
বর্তমানে সরকারের অগ্রাধিকারের খাতগুলোর একটি স্বাস্থ্যখাত। অথচ চিকিৎসা খাতে দেশে মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৩০ ডলার। প্রতিনিয়ত চিকিৎসা খাতে মানুষের খরচ বেড়ে চলেছে। দেশের ১৫ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। দেশে ওষুধের জন্য খরচ হয় ৪১ শতাংশ। সে হিসেবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী জনপ্রতি ওষুধের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৪৯ দশমিক ৩১ টাকা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট থেকে জানা যায়,দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাচ্ছেন। আর তারা চিকিৎসার জন্য যে টাকা খরচ করছেন তার ৭০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে ওষুধের পেছনে।
জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম মানুষ সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা নিতে যান। বাকিরা যান বেসরকারি হাসপাতালে। তাদের খরচটা সরকারি হিসেবের মধ্যে আসে না। অপরদিকে, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনও ইউনানি, হোমিওপ্যাথি,পল্লিচিকিৎসক ও হাতুড়ে চিকিৎসকসহ অন্যদের কাছে যান।
দেশে বর্তমানে ক্লিনিক্যালি (চিকিৎসকদের কাছে পরিচিত) ১৪ হাজার ৪০০ অসুখ রয়েছে। যার বেশির ভাগেরই চিকিৎসা হয় ওষুধে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে জানা যায়,এক হাজার ৪০০টি জেনেরিকের ২৭ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি করা হয় দেশে। এর মধ্যে কেবল ১১৭টি ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানান, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের (অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগ) তালিকা বৃদ্ধি না পাওয়া এবং ওষুধ নীতি ২০০৫ কার্যকর না হওয়ার সুযোগ নিয়েই ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে ওষুধের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে, যেটি সরকারি বরাদ্দের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
চিকিৎসা
অনুসন্ধানে জানা যায়, আট থেকে ৯ মাস আগেও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ক্যালবো ডি-এর কৌটা ছিল ১৫০ টাকা করে, কিন্তু তিন মাস ধরে ক্যালবো ডি-এর একই কৌটা বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। ‘বেক্সট্রাম সিলভার’ বিক্রি হতো ১৫০ টাকায়, চার মাস আগে থেকে তা বিক্রি হচ্ছে ২৮৫ টাকায়। মগবাজারের ওয়ারল্যাসে অবস্থিত রমনা ফার্মেসিতে আসা নুজহাত বলেন, ‘প্রতিবেলায় যে ওষুধ খেতে হয় সেটির দাম যদি একবারে ৬০ টাকা বেড়ে যায়, তাহলে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ ওষুধ খাবে কী করে?’ ভুক্তভোগীরা বলছেন, অনেক পরিবারেই এমন সদস্য রয়েছেন, যাদের নিয়মিত কয়েক ধরনের ওষুধ খেতে হয়। উপার্জনের একটি বড় অংশ চলে যায় এই ওষুধ কিনতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান জানান, মানুষের চিকিৎসা খরচের দুই-তৃতীয়াংশই যায় ওষুধ কিনতে। তিনি বলেন, ‘১৬ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজারের মধ্যে সরকারের খরচ ৬৫০ কোটি টাকা। আর বাকি ১৫ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার ওষুধ কিনছে মানুষ নিজের পকেট থেকে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এবিএম ফারুক বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যখাতের প্রধান ও অন্যতম ব্যয়ের খাত হচ্ছে ওষুধের মূল্য। আবার দেশের মানুষের জন্য জনপ্রতি ওষুধের জন্য বরাদ্দ কতো টাকা এমন কিছু আমাদের নেই। কারণ হচ্ছে, সরকারের এ ধরনের পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু এটি বের করা খুব দরকার। তাহলে এটি হবে আমাদের অন্যতম একটি হেল্থ ইনডিকেটর। ’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবছর ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে কেবলমাত্র স্বাস্থ্যব্যয় মেটাতে। এর মধ্যে প্রধান খরচ ওষুধ কেনা। কিন্তু স্বাস্থ্য বাজেটের বেশিরভাগ খরচ হয় নানারকম অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য। অপরদিকে, সবচেয়ে বড় অংশ ব্যয় হয় সংশ্লিষ্ট খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে।’ এরপরে যেটা অবশিষ্ট থাকে, তার একটা অংশ সরকার ওষুধের জন্য ব্যয় করে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু বেশিরভাগ টাকা যাচ্ছে অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য, সেহেতু সেখানে দুর্নীতির সুযোগ বেশি। এটি এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত, তা আমরা সবাই জানি।’
ডা.মোজাহেরুল হক বলেন, ‘দেশের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী ওষুধ কেনাসহ ডায়াগনোসিস করতে অসামর্থ্য। সুতরাং, সরকারের নীতি হওয়া উচিত অসুখ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং একইসঙ্গে যখন কারও কোনও অসুখ ধরা পড়বে তাকে যেন প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যায়,সে ব্যবস্থা করা।’
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসা ব্যয়ের কত শতাংশ কোন খাতে খরচ হয় তা নিয়ে ২০১২ সালে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস’ নামের একটি জরিপ হয়, যা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। তবে চলতি আগস্ট মাসে এ সম্পর্কিত নতুন জরিপ প্রকাশিত হবে। সেখানে সর্বশেষ অবস্থা জানা যাবে।’
স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রোমানা হক বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওষুধ বরাদ্দ ছাড়া আরও বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের দেওয়া ওষুধ মিলিয়ে কতো টাকার ওষুধ খরচ হয়, সেভাবে জরিপ দেশে নেই। একমাত্র বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যকাউন্টস ছাড়া। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে খরচ রয়েছে ওষুধ খাতের জন্য, সেটা অবশ্যই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। আমাদের দেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ অন্যান্য খরচের তুলনায় ওষুধের বাজেটে সবসময়ই কম বরাদ্দ থাকে। মেডিক্যাল অ্যান্ড সার্জিকাল রিকুইজিটে (এমএসআর) সরকারের বাজেট সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়লেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সেটা হয় না।’