বিশেষ প্রতিনিধি : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কাউতলি রেলস্টেশন থেকে কিছুটা দূরে আফনান আলম সাকিব নামের এক উদ্যমী ছেলের বাড়ি । তবে সবাই তাকে সাকিব নামেই চেনে। জেলা শহরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। বাড়ির পাশে রেললাইন হওয়ায় প্রায় বিকেলেই ছুটে যাওয়া হয় স্টেশনে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে।
সেখানে চা-নাস্তার পাশাপাশি রোজ রোজ কিছু করুণ মুখ সাকিবের প্রায়ই নজরে পরতো। তারা ছিল হত দরিদ্র পরিবারের ফুটপাতে থাকা একদল শিশু যাদের নুন আনতেই পানতা ফুরায় আর শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়া তো কল্পনার জগতে বসবাসের মতো। সাকিবের ভাষায় ওরা পথের তারা যাদের দিয়েও দেশের উন্নতি সম্ভব কিন্তু তাদের নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই, একটু হাসিমুখে দু চারটি কথা বলার কেউ নেই ।
দিন যেতে যেতে সেইসব তারাদের নিয়ে সাকিবের ভাবনা গভীর হতে লাগলো। ওদের নিয়ে কিছু করার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। স্থানীয় সংগঠন যদিও প্রায়ই নানা রকম উদ্যোগ নেয়, কিন্তু সেগুলো ক্ষণস্থায়ী। সাকিবের ইচ্ছা হলো ওদের স্বাক্ষর দেওয়া শিখাবে। ওদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিবে।
যেই ভাবনা সেই কাজ। বন্ধু রুবেল এবং অন্তর কে সাথে করে সাকিব স্টেশনেই একটি উন্মুক্ত স্কুল খুলে ফেলল। নাম দিল “পথতারা স্কুল”। শুরুটা কিন্তু এতটাও সোজা ছিল না। সেই ক্ষুধার্ত পথের তারাদের জোগাড় করে পড়ায় বাধ্য করতে তাদের নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। চকলেট এবং খাবার নিয়ে স্কুলের কার্যক্রম শুরু করতে হতো। যেন খাবারের বিনিময়ে হলেও তারা পড়াশোনা করতে ছুটে আসে। এই কাজেও দেখা গেল প্রতিবন্ধকতা। “ছেলেধরা” ভেবে তো ওদের রীতিমত আটকেই রেখেছিল পথতারাদের মা-বাবা। কিন্তু পরে স্থানীয় মুরুব্বি, সাকিবের স্কুলের প্রধান শিক্ষক এমনকি থানার ওসি এসে বলে ওদের উদ্দেশ্য মহৎ, ওরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে।
ধীরে ধীরে সবার ভুল ধারণা দূর হলো। কিন্তু নিন্দুকের নিন্দা থেকে সাকিব এবং তার দল রেহাই পায়নি। অনেকে আবার স্কুল টা কিনেও নিতে চাইলো। কিন্তু ওদের উদ্দেশ্য তো ব্যবসা করা নয় ,উদ্দেশ্য সবার মতো তাদের মধ্যেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ুক অটল সিদ্ধান্ত এবং শক্ত অবস্থান ওদের পিছ পা করেনি। ওরা এগিয়ে গিয়েছে। ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর যে স্টেশনে মাত্র একজন পথতারা নিয়ে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, আজ সেখানে নিয়মিত ৫০-৭০ জন পথতারা আলো জালাতে যায়। ওদের আরেকটি শাখা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্যাংকের পাড়। এখন এই স্কুলে আর শিক্ষকের ও অভাব হয় না। অনেকেই স্বেচ্ছায় আসে ক্লাস নিতে। অনেকেই বাচ্চাদের সাথে কিছুটা সময় কাটায়। এই স্কুলের যাবতীয় খরচ বহন করে সাকিব এবং তার দল নিজেরাই। তাদের জমানো টাকায় চক, পেন্সিল, চকলেট কেনা হয়। তারা সাহায্যের জন্য কারো দরজায় কড়া নাড়ে না। এই শীতেও তারা পথতারাদের বস্ত্র বিতরণ করে। শিক্ষাদানের পাশাপাশি নানা রকম কার্যক্রম সাকিবের স্কুলকে আরো বড় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এই সাকিবদের ই আমাদের দেশে দরকার। শহরে শহরে, মহল্লায় মহল্লায় এদেরই তো আমাদের দরকার। এরাই পারে দেশটাকে সুন্দর করে সাজাতে। “পথতারা স্কুল” ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষদের কাছে তাই একটি ভালোবাসার নাম। এগিয়ে যাক সাকিব সফল হোক তার উদ্দেশ্য।