আমিরজাদা চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ কেন নাসিরনগরে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল? সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই কি পরিকল্পিত ভাবে সে দিন তান্ডব চালানো হয়েছিল। সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা কেন নিরব ছিল। এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। বুধবার নাসিরনগর ডাক বাংলোতে সাংবাদিকদের সাথে আলাপ কালে খোদ স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট মো. ছায়েদুল হক এর বক্তব্যে এমন আভাসই মিলছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের দলীয় কোন্দল, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বপালনে শৈথিল্যতা সে দিনের ঘটনার জন্য দায়ী। অন্যদিকে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগাম সর্তক বার্তাতে হামলা পূর্ববর্তী পরিস্থিতি ও সর্তকতা সম্পর্কে আভাস না দেয়ায় রবিবারের চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা মনে করে। ঘটনার আর্কষ্মিক ভয়াবহতায় অসহায় হয়ে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন। তবে জেলার পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। শান্তিপূর্ন সমাবেশ কেন অশান্তিপূর্ন হল তা নিয়ে কর্মকর্তারা ও হকচকিত হয়ে পড়েন। তবে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনে স্থানীয় পুলিশ এবং প্রশাসনের কোন অবহেলার কথা মানতে নারাজ কর্মকর্তারা।
একটি সুত্র জানায়, সেদিন যদি কোন অবহেলা থেকে থাকে সে জন্যেই তো পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারাই প্রকৃত ঘটনার কারন খুঁজে বের করবে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, পবিত্র কাবা শরীফের উপর শিব মূর্তি স্থাপনের ঘটনাটি নজরে আসে ২৮ অক্টোবর সকাল ৯ টায়। উপজেলার হরিনবেড় গ্রামের রসরাজ দাস (৩০) এর আইডি থেকে ছবিটি পোষ্ট করা হয়। মুহুর্তের মধ্যেই ছবিতে লাইক ও শেয়ার দেয় বেশ কিছু লোক। দ্রুত খবরটি জানাজানি হয় সবখানে। স্থানীয়রা তাকেআটক করে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসে। এদিনই পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। রাতেই ঘোষনা দেয়া হয় রবিবার বিক্ষোভ মিছিল হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মামলা ও আসামী ধরা পড়ায় প্রতিবাদ করার কিছুই নেই। তারপরও গ্রামে গ্রামে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন বিক্ষোভের সমর্থনে উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে মাইকিং করা হয়। কাবা শরীফ অবমাননার প্রতিবাদে মসজিদের মাইক থেকে মাইকিং করা হয়। পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, মূলত পবিত্র কাবা শরীফকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক করায় প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি হয় সাধারন মানুষের মাঝে। প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমন ম্যাসেজ আমরা পাই। প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে পুলিশের পক্ষ থেকে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। এরমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি নিয়ে সকাল সাড়ে ১০ টায় কলেজ মোড় ও আশুতোষ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমাবেশ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন রাখতে সকালে সেখানে ১ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। সে সাথে বাড়ে লোক সমাগম। পরে আরও এক প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ডাকা হয় র্যাব, বিজিবি এবং অতিরিক্ত পুলিশ। উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ, আহলে সুন্নত জামাত নেতৃবৃন্দ, পুলিশ কর্মকর্তা প্রশাসনের কর্তাসহ অনেকেই বক্তব্য রাখেন সেই সমাবেশে। দুপুর প্রায় ১২ টায় খবর আসে বেশ কিছু যুবক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসা বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে পৌছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। পুলিশের ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, প্রায় পৌনে ১ ঘন্টার মধ্যেই নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করে দুর্বত্তরা। এ ফাঁকেই কর্মকর্তাসহ পুুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। সংখ্যালঘুদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে গ্রামে গ্রামে পুলিশী টহল চালু করা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। এদিকে নাসিরনগরের সুশীল সমাজ বলছে, সেদিনের ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের মারাত্মক ঘাফিলাতি ছিল। কোন কোন জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোন্দলকেও দায়ী করেছেন। কোন্দলের কারনে ঘাপটি মেরে থাকা অপরাধীরা দীর্ঘদিনের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে চিড় ধরাতে চেষ্টা করেন। আ’লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ বলেন, আমরা প্রশাসনের তেমন সহযোগীতা পায়নি। নিজেরা লাঠি নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেছি। তিনি আরো বলেন, সংখ্যা লঘুদের রক্ষা করতে গিয়ে যারা আহত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ইউপি চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি বলেন, স্থানীয় মন্ত্রীর আর্শিবাদের যারা রাজনীতি করছে তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট সায়েদুল হক বলেছেন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সকলকে নিয়ে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছি। তবে কিভাবে কারা ছবি পোষ্ট করেছে এসব বের করে এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর এবং মন্দিরে হামলাকারীদের খুঁজে বের করা হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩(সদর) আসনের সংদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেছেন, যারা অপরাধী তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা এবং উস্কানীই এর জন্য দায়ী।