নিজস্ব প্রতিবেদক : সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যাপারে নতুন প্রস্তাব দেবে বিএনপি। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীব উদ্দিন আহমদ ও অপর চার নির্বাচন কমিশনারের মেয়াদ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হচ্ছে। নতুন নির্বাচন কমিশনার যাতে সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং কমিশন যাতে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারে সে জন্য একটি কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার বাছাই করার প্রস্তাব দেয়া হবে।
এই কমিটিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একজন প্রতিনিধি, বিরোধী দল বিএনপির একজন প্রতিনিধি, একজন বিশিষ্ট নাগরিক, একজন বিচারপতি এবং একজন সচিবকে নিয়ে এই কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। এ ছাড়া কমিটিতে প্রয়োজনে আরো দু-একজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই কমিটি সর্বসম্মতভাবে যাকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যোগ্য মনে করবে তাকে নিয়োগ করা হলে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো দলের পক্ষে আর অভিযোগ আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করছে বিএনপি। ফলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ইতোমধ্যে দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। যদিও কত সদস্যের কমিটি হবে এবং কবে নাগাদ এই প্রস্তাব দেয়া হবে তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এ কারণে বিশে^র বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ বিশেষ করে ভারত, ব্রিটেন এবং ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ, ক্ষমতা ও নির্বাচনকালীন কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি টিম কাজ করছে। তাদের রিপোর্ট পাওয়ার পর বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপন করবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল নানা ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এর প্রতিফলন ঘটেছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় অনুগত ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আগের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। ক্ষমতাসীনদের পছন্দের একজন আমলাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি চায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আগে রাজনৈতিক দল ও দেশী-বিদেশী সব মহলের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা দিতে। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নয় আন্তর্জাতিক মহলের বিশেষ দৃষ্টি আছে। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু সম্প্রতি বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অগ্রাধিকারে রয়েছে। আগামী ২০ ডিসেম্বরে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠেয় ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন বিষয়ক সাব-গ্রুপ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে এটিকে শীর্ষে রাখা হয়েছে। ১৭ অক্টোবর কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সাথে এক আলোচনায় আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করতে ইইউ কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেÑ জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নতুন কমিশন গঠনের েেত্র আমরা সরকারের সাথে কাজ করছি। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করতে ইইউর ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি রয়েছে।
দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে এর আগে বাংলাদেশে বহু বিতর্ক হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। এই নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের যে বাধ্যবাধকতা তা লঙ্ঘিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সরকারের ওপর তাগিদ থাকবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন সরকার যদি একতরফাভাবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয় তাহলে আগামী নির্বাচন যে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলকভাবে করার ব্যাপারে সরকার আন্তরিক নয় তা প্রমাণ হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া যে সম্ভব নয় তাও প্রমাণিত। তারা বলছেন বর্তমান নির্বাচন কমিশন শুধু ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব:) মাহবুবুর রহমান বলেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে নিরপেক্ষ ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। যেমন আমরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে দেখেছি। তিনি বলেন, বিএনপি মনে করে সব রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সাথে আলোচনা করে সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আগে যে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল তা বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপির এ ধরনের প্রস্তাবের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি এমন প্রস্তাব দিতে পারে, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল গ্রহণ করবে কি না সেটাই প্রধান বিষয়। তিনি মনে করেন, এ ধরনের কমিটিতে আরো রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচন সঠিক সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক হবে কি না তা নির্ভর করবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে নিয়োগ দেয়া। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ প্রধানমন্ত্রীকে তৈরি করতে হবে।
উল্লেখ্য ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন গঠনে নামের সুপারিশ তৈরি করতে চার সদস্যের সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারককে সভাপতি করে গঠিত কমিটিতে সদস্য হন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশন চেয়ারম্যান। এই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাজী রকীব উদ্দিন আহমদ, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, মোহাম্মদ আবু হাফিজ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মো: জাবেদ আলী ও মো: শাহনেওয়াজের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুসারে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এই কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ১৫১ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে।