ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লেডি সন্ত্রাসী
---
বহু অপরাধের নায়িকা। বেপরোয়া নারী। পুলিশ বলছে, মাদক ব্যবসায়ী আর ব্ল্যাকমেইলার। আপন বোনের চোখে ‘মহিলা সন্ত্রাসী’। অপরাধ জগৎ দাবড়ে বেড়ানো এই নারী ক’দিন আগে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। শহরের কুমারশীল মোড়ে দু’ফল ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাত করার ঘটনায় এবার ধরা পড়ে সে। তাকে দেখার জন্য ভিড় জমে যায় থানায়। নাম তাহসীনা আক্তার ওরফে সুমি হাজারী (৩০)। এই একটি ঘটনাতেই তাকে ঘিরে চাঞ্চল্য থেমে থাকেনি। শত অপরাধের নায়িকার অপরাধ বৃত্তান্ত দীর্ঘ। গ্রেপ্তারের পর লেডি সন্ত্রাসীর অ্যাকশনের খবর টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয় মুহূর্তে। ফল ব্যবসায়ীকে ছুরি মারার ঘটনার মামলার এক নম্বর আসামি সে। গ্রেপ্তারের পরদিন আপন বোন দিয়েছেন ভগ্নিপতি আর বোনের মেয়েকে অপহরণের মামলা। আগে রয়েছে আরও ৪ মামলা। প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য আর চিহ্নিত অপরাধীদের সঙ্গে ওঠাবসার কারণে তাকে ঘাঁটাতে সাহস পায় না কেউ। অনেক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গেও তার রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। একাধিকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও ছাড়া পেয়ে যায় সহজে সে। এবার ধরা পড়ার পর হুঙ্কার দেয় সুমি। মহিলা পুলিশ তার হাত ধরতে গেলে বলে ‘গায়ে হাত দেবে না।’ সাংবাদিকদের ছবি ওঠাতেও বারণ করে। ক্যামেরা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালায় পুলিশের সামনেই। কাগজে কলমে বিয়ে হয়েছে তার দু’টি। এর বাইরে আরও অনেকের স্ত্রী হিসেবেই চাউর আছে তার নাম। তার রূপ-সৌন্দর্যের আগুনে অঙ্গার হয়েছে বহুজন।
কে এই সুমি: সদর উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের পাতিরহাতা গ্রামের জিল্লু মিয়ার বড় মেয়ে সুমি। পুরো নাম তাহসীনা আক্তার ওরফে সুমি হাজারী। জিল্লু মিয়ার প্রথম স্ত্রীর ঘরের দু’ মেয়ের মধ্যে বড় সে। আরেক বোন জিয়াসমিন। জিল্লু মিয়া পরে আবার বিয়ে করেন। ওই ঘরে রয়েছে ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। পিতার সঙ্গে মায়ের বিচ্ছেদের পর অল্প বয়সেই বিপথে চলে যায় সুমি। তার বোন জিয়াসমিন জানান, সুমির প্রথম বিয়ে হয় ২০০০ সালে। নরসিংদীর এক হোটেল মালিকের সঙ্গে। এরপর স্বামীকে ফেলে ২০০৭ সালে আবার বিয়ে করে জিয়াসমিনের দেবর শেখ আনিসুর রহমানকে। জিয়াসমিন জানান, এখনও দু’জনকেই নিজের স্বামী বলে দাবি করে সুমি। এই দুই স্বামীর বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় মামলাও দিয়েছে সে। তবে কাগজপত্রের এই দুই স্বামীর বাইরে আরও ক’জন স্বামীর কথা জানা গেছে। তার গ্রামের লোকজন এলাকার ধনাঢ্য এক জনপ্রতিনিধির ৪র্থ বিবি হিসেবে জানে তাকে। ওই জনপ্রতিনিধি নিয়মিতই যাতায়াত করতেন সুমির পাতিরহাতার বাড়িতে। জিয়াসমিন বলেন, সে একটা নোংরা মেয়ে। যত কুকর্ম আছে সবই করে সে। ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল ও মদ সব নেশাতেই অভ্যস্ত। কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এক গ্রামবাসী জানান, বিয়ের আগে থেকেই সে উচ্ছৃঙ্খল। নরসিংদীতে এক হোটেলে প্রথম ধরা পড়ে সে। এরপর ভৈরব, চাঁদপুরে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। আখাউড়ায়ও একবার ফেনসিডিল সহ ধরা পড়ে।
অপরাধ জগতে বিচরণ: পুলিশ জানিয়েছে, হোন্ডা চোর, চোর-ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী, দেহ ব্যবসায়ী সবই আছে তার দলে। পুরুষ কিলার সে। রূপের ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করে টার্গেট করা পুরুষদের। মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে মুক্তি দেয়। তার এক ভাই হোন্ডা চুরির সঙ্গে জড়িত। একাধিক মামলাও রয়েছে। আরেক ভাই মাদক ব্যবসায়ী। সুমি নিজেও আসক্ত। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে অনেক। সে কারণে মহিলা সন্ত্রাসী হিসেবেই জানে তাকে নিজ গ্রামের মানুষ। গত ১০ই ফেব্রুয়ারি শহরের কুমারশীল মোড়ে ফল কিনতে গিয়ে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয় সুমি। একপর্যায়ে ফোন করে তার দলের দু’সন্ত্রাসীকে ডেকে আনে সেখানে। তাদের ছুরিকাঘাতে আহত হয় দুই ফল ব্যবসায়ী মহরম আলী (৩৬) ও জাহের মিয়া (২৪)। এসময় ধস্তাধস্তিতে সুমিও আহত হয়। এ ঘটনায় আহত কুমারশীল মোড়ের জোনাকী ফল হাউজের মালিক মহরম আলী বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় ৩ জনকে আসামি করে মামলা দেন। অন্য ২ আসামি জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মাসুম বিল্লাহর ছোট ভাই মাসুদ মিয়া (৩০) ও কালাইশ্রীপাড়ার সেলিম মিয়ার ছেলে লালু (৩২)। মহরম আলী অভিযোগ করেন, সুমি ফলের ঝুড়িতে লাথি মারে। এর প্রতিবাদ করলে সুমির সঙ্গে তর্কবিতর্ক হয়। এরপর সে ফোন করে মাসুদকে নিয়ে আসে। মাসুদ ছরিকাঘাত করে আমাকে। লালু মিয়া ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমার ভাই জাহেরকে আঘাত করে। এরপর দোকান থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আটক করে সুমিকে। পাতিরহাতা গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার সন্ত্রাসী তৎপরতা থেকে রেহাই পায়নি আপন এক মামা ও খালা। এক গ্রামবাসী জানান, তার মামা আজিজ মিয়ার জায়গা দখল করে সে। এ ঘটনায় মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। নূরজাহান নামে আরেকজনের ঘরদুয়ার পুড়িয়ে দেয়। আপন খালাকে মারধর করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। ২০১১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের উপনির্বাচনের সময় উড়শীউড়া কেন্দ্রে এক এসআইকে মারধর করেছিল সুমি। শহরের শিমরাইলকান্দির বিএনপি নেত্রী আয়েশা খাতুনকে মারধর করার ঘটনায় ২০১১ সালের ১৫ই জুন মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ঘটনার বিষয়ে আয়েশা জানান, তিনি উড়শীউড়ায় জেলা কারাগারে যাওয়ার জন্য কাউতলীর মোড় থেকে একটি অটোতে ওঠেন। তাতে আগেই বসা ছিল সুমি আর তার সঙ্গী একটি ছেলে। অটোটি উড়শীউড়া পৌঁছার পর কারাগারের সামনে যাবে না বলে আয়েশাকে পাতিরহাতা রাস্তার মোড়ে নেমে যেতে বলে সুমি। আয়েশা এর কারণ জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অশ্লীল গালাগাল দিয়ে শুরু করে মারধর। এতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন আয়েশা। এরপর আয়েশার ২০০০ টাকাসহ ব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হয়। গলা থেকে স্বর্ণের চেইনটিও খুলে নিয়ে যায়। আয়েশা জানান, তার জ্ঞান ফিরলে বাড়িতে ফোন করলে আত্মীয়স্বজন গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। গ্রামে এই মেয়ের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে স্থানীয় এক ধনাঢ্য জনপ্রতিনিধির ৪ নম্বর স্ত্রী। আমরা ওই জনপ্রতিনিধির বাড়িতে যাই ঘটনার বিচার চাইতে। তার কাছে বিচার না পেয়ে অবশেষে মামলা করি। এই মামলায় ২০১৩ সালের ২১শে আগস্ট সুমির এক বছরের সাজা হয়। এ ঘটনার জন্য সুমির বিচারের দাবিতে তখন মানববন্ধনও করা হয়। আয়েশা বলেন- জিন্সের প্যান্ট আর টাইট গেঞ্জি পরা ছিল ঘটনার সময় সুমির। বাংলাদেশের মেয়ে বলে মনে হয়নি তাকে দেখে। এদের চূড়ান্ত বিচার হওয়া উচিত। গ্রামের লোকজন জানিয়েছে ৭-৮ জন ছেলেপুলে নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়ায় সে- কি দিন, কি রাত- কখনও হোন্ডায় চেপে কখনও গাড়িতে। পাতিরহাতায় তার বাড়িতে আসা-যাওয়া আছে অনেক হোমরা চোমরার। প্রাইভেট কার ও হোন্ডায় দিন-রাত আসা-যাওয়া আছে তাদের। একারণে পাতিরহাতা-উড়শীউড়া গ্রামের মানুষ সুমির ভয়ে তটস্থ থাকে সবসময়। তার অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পেতে ওই ইউনিয়নের সকল সদস্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিল একাধিকবার। সুমির আপন চাচা স্থানীয় প্রভাবশালী ইউপি সদস্য কিরণ মিয়া। সুমির বিরুদ্ধে কথা বলতে তিনিও সতর্ক। কিরণ মিয়া বলেন, সবাই কি ভাইঝি হয়। আমার ভাইঝি বললেই কি ভাইঝি হয়ে গেল। এদের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ নেই। ভাল বা খারাপ কোনটিই বলতে পারবো না। তার হাত বড় লম্বা।
অপহরণ মামলা বোনের: সুমি গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন ১১ই ফেব্রুয়ারি আপন বোন জিয়াসমিন হাজারী একটি মামলা দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে। মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে শিশু অপহরণ, সহায়তাসহ মনুষ্যহরণ ও প্ররোচনাদানের অপরাধে ৩৬৪/১০৯ ধারায় এই মামলা দেয়া হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৬ই ফেব্রুয়ারি সকালে জিয়াসমিনের স্বামী আখাউড়ার দেবগ্রামের বাসিন্দা শেখ বশির মিয়া তার মেয়ে বুশরাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাতিরহাতা বেড়াতে যান। বিকালে ফেরার পথে উড়শীউড়া পাকা সড়ক থেকে বশির আর তার মেয়েকে মাইক্রোতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জানতে পারেন পাতিরহাতা গ্রামে আটক করে রাখা হয়েছে তাদের। সেখানে গিয়ে স্বামী ও সন্তানের খোঁজ করলে উল্টাপাল্টা বলে জিয়াসমিনকে ফিরিয়ে দেয় সুমি। মামলা দায়ের করার পরদিন পুলিশ বুশরাকে উদ্ধার করে। কিন্তু এখনও বশিরের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই মামলায় আসামি করা হয় পাতিরহাতা গ্রামের মুসলিম মিয়ার মেয়ে শিমু আক্তার (২৫), জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মাসুম বিল্লাহর ছোট ভাই মাসুদ মিয়া (৩০), কালাইশ্রীপাড়ার সেলিম মিয়ার ছেলে লালু (৩২), পাতিরহাতা গ্রামের মুসলিম মিয়ার স্ত্রী মিষ্টু বেগম (৫৫)-কে। মামলার আবেদনে জিয়াসমিন আরও বলেন- সুমির আচার আচরণ ভাল নয়। সে বিভিন্ন লোকজনকে নানা কৌশলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। তার স্বামীর মুক্তির জন্যও সে প্রথমে ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি) মো. আব্দুর রব বলেন, সুমি শহরের চিহ্নিত ব্ল্যাকমেইলার। বিভিন্ন সময়ে সে ছেলেদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করে। তার বিরুদ্ধে সদর থানায় আগের তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্তের ওয়ারেন্ট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মামলা নম্বর-৭৩,তারিখ ২০/১/২০১২ ইং, জিআর ৩৯/১১,তারিখ ৯.৩.১১, ননজিআর ৬১/১১, জিআর ৫৯৪/১১। তিনি আরও বলেন, সে মাদকাসক্ত। শহরের অনেকের সঙ্গেই রয়েছে তার মধুর সম্পর্ক। এর আগে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গাজী সাখাওয়াতের সময় সে একবার আটক হয়েছিলো। তখন তাকে প্রভাবশালীদের তদবিরে ছেড়ে দিতে হয়। ঢাকার ভাটারা থানা পুলিশ সুমিকে একবার গ্রেপ্তার করেছিল। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা রিমান্ডে দেয়ার আবেদন করবো।
মানবজমিন