ফাঁসির আগে মাকে লেখা রেহানের শেষ চিঠি

বিশ্বব্যাপী প্রবল প্রতিবাদ ও সমালোচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইরানের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক নারীর দণ্ড কার্যকর করে দেশটির সরকার। তেহরানের একটি কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। হতভাগ্য ওই নারীর নাম রেহানে জাবারি। এক সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার দায়ে ২৬ বছরের এই নারীর বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে মৃত্যুদণ্ড রায় ঘোষণা করে তেহরানের একটি আদালত।

মোর্তুজা আবদুল আলি সারবান্দি নামের ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তাকে ছুরিকাঘাত করেছিলেন জাবারি। তবে জাবারি দাবি করেন, তিনি ছুরিকাঘাত করলেও খুনটি করেছেন অন্য কেউ। সারবান্দিকে খুনের অভিযোগে ২০০৭ সালে গ্রেফতার হন জাব্বারি। এরপর দুই মাস তাকে নির্জন কারাগারে বন্দি রাখা হয়। ওই সময় তাকে পরিবার বা আইনজীবীর সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সারবান্দির মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তৎপর ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো। এ রায়কে ‘গভীর দ্বিধান্বিত তদন্ত ও বিচার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

অ্যামনেস্টি বলছে, সারবান্দিকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাতের কথা স্বীকার করলেও জাবারি অভিযোগ করেছেন সে সময় ওই বাড়িতে আরও একজন ছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই ব্যক্তিই খুনটি করেছেন। মৃত্যুর আগে মাকে শেষ চিঠি লিখে গিয়েছেন রেহানে। হৃদয় নিংড়ানো সেই চিঠিতে মাকে শোকগ্রস্ত হতে বার বার বারণ করেছেন তিনি। মৃত্যুকে তিনি অভিহিত করেছেন নিয়তির বিধান হিসেবে, তবে সে জন্য তিলমাত্র অনুতাপ করেননি। বরং ফাঁসির পর তার দেহাংশ দান করার অনুরোধ জানিয়েছেন জন্মদাত্রীকে।

রেহানের সেই মর্মস্পর্শী চিঠি গণমাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছেন মানবাধিকার সংগঠন ও শান্তিকামী গোষ্ঠীর সদস্যরা। মাকে লেখা রেহানে জাবারির শেষ চিঠি প্রিয় শোলেহ, আজ জানতে পারলাম এবার আমার কিসাস (ইরানের আইনব্যবস্থায় কর্মফলবিষয়ক বিধি)-এর সম্মুখীন হওয়ার সময় হয়েছে। জীবনের শেষ পাতায় যে পৌঁছে গিয়েছি, তা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি ভেবে খারাপ লাগছে। তোমার কি মনে হয়নি যে এটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল? তুমি দুঃখে ভেঙে পড়েছ জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তোমার আর বাবার হাতে চুমু খেতে দাওনি কেন আমায়? দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছে। সেই অভিশপ্ত রাতে আমারই তো মরে যাওয়া উচিত ছিল, তাই না? আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল শহরের কোনো অজ্ঞাত কোণে। কয়েক দিন পর মর্গে যা শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার। সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা অবশ্যই ধরা পড়ত না, কারণ আমাদের না আছে অর্থ, না ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হতো। এটাই যে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাতের আকস্মিক আঘাত সব কিছু ওলোটপালট করে দিল। শহরের কোনো গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে ছুড়ে ফেলা হলো এভিন জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে, আর সেখান থেকে কবরের মতো এই শাহর-এ রায় কারাগারের সেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ ক’রো না মা, এটাই নিয়তির বিধান। আর তুমি তো জানো যে মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না। মা, তুমিই তো শিখিয়েছ অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই আমাদের জন্ম। তুমি বলেছিলে, প্রত্যেক জন্মে আমাদের কাঁধে এক বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া থাকে। মাঝে মাঝে লড়াই করতে হয়, সে শিক্ষা তো তোমার থেকেই পেয়েছি। সেই গল্পটা মনে পড়ছে, চাবুকের ঝাপ্টা সহ্য করতে করতে একবার প্রতিবাদ জানানোর ফলে আরও নির্মমতার শিকার হয়েছিল এক ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিবাদ তো সে করেছিল! আমি শিখেছি, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে, নালিশ ও ঝগড়াঝাটির মাঝেও যেন নিজের নারীসত্ত্বাকে বিসর্জন না দিই। তোমার মনে আছে মা, কত যত্ন করেই না মেয়েদের খুঁটিনাটি সহবত শিখিয়েছিলে আমাদের? কিন্তু তুমি ভুল জানতে মা। এই ঘটনার সময় আমার সে সব তালিম একেবারেই কাজে লাগেনি। আদালতে আমায় এক ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু আমি চোখের পানি ফেলিনি। ভিক্ষাও করিনি। আমি কাঁদিনি কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা ছিল। কিন্তু বিচারে বলা হলো, খুনের অভিযোগের মুখেও নাকি আমি নিরুত্তাপ। আচ্ছা মা, আমি তো কোনোদিন একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড় ধরে জানলার বাইরে ফেলে দিয়েছি। সেই আমিই নাকি মাথা খাটিয়ে মানুষ খুন করেছি! উল্টো ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের ওপর কী সুন্দর নেল পালিশের জেল্লা ছিল। হাতের তালু কত নরম তুলতুলে ছিল। সেই বিচারকের হাত থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড় আশাবাদীও করতে পারে কি? তাই তো নারীত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জনবাসের হুকুম দেওয়া হলো। দেখেছ মা, তোমার ছোট্ট রেহানে এই কয়েক দিনেই কতটা বড় হয়ে গিয়েছে? এবার আমার অন্তিম ইচ্ছেটা বলি শোনো। কেঁদো না মা, এখন শোকের সময় নয়। ওরা আমায় ফাঁসি দেওয়ার পর আমার চোখ, কিডনি, হৃদযন্ত্র, হাড় আর যা যা কিছু দরকার যেন আর কারও জীবন রক্ষা করতে কাজে লাগানো হয়। তবে যিনিই এসব পাবেন, কখনোই যেন আমার নাম না জানেন। আমি চাই না এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক। এমনকি তুমিও নয়। আমি চাই না আমার কবরের সামনে বসে কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙে পড়ো তুমি। বরং আমার দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও। এই পৃথিবী আমাদের ভালোবাসেনি, মা। চায়নি আমি সুখী হই। এবার মৃত্যুর আলিঙ্গনে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার এজলাসে সুবিচার আমি পাবই। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগের আঙুল তুলব সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারের দিকে, বিচারকদের দিকে, আইনজীবীদের দিকে, আর তাদের দিকে যারা আমার অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে, বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে। একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায় সেটাই সর্বদা সত্যি নয়। আমার নরম মনের শোলেহ, মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে। আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়। দেখিই না, সৃষ্টিকর্তা কী চান! তবে একটাই আরজি, মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরুর প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই, মাগো! তোমায় যে খুব খু-উ-ব ভালোবাসি।