‘আমাদের তো ঈদ নেই এসেছি বড় ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে’
নিউজ ডেস্ক।। ‘প্রতি ঈদেই বড় ভাই কেনাকাটা করে দিতেন, লঞ্চে টিকিট কেটে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন। এবারও নানাবাড়িতে এসেছি বড় মামার সঙ্গে, কিন্তু বড় ভাই নেই। এবার তো আমাদের ঈদ নেই। এসেছি শুধু বড় ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে।’ কথাগুলো বলছিল ঢাকার রাস্তায় দুই বাসের রেষারেষিতে পড়ে নিহত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হাসানের ভাই হাফেজ মেহেদী হাসান। বাবা-মায়ের পর বড় ভাই হারানো হাফেজ মেহেদী ও তার ছোট ভাই হৃদয় হাসান আবদুল্লাহ বুধবার সকালে নানাবাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার দাসপাড়ায় পৌঁছে বড় মামা জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। ওই দাসপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন রাজীব হাসান।
মেহেদী হাসান আরও বলে, ‘মা-বাবার আদর-ভালোবাসা পাইনি। ভাই-ই ছিল সব। কোনো দিন মা-বাবার অভাব বুঝতে দেননি। খেয়েছি কিনা, কী খেয়েছিÑ সব খোঁজ তিনি রাখতেন। সেই ভাই আজ নেই। সবাই ঈদে বাড়ি আসে আনন্দ করতে। ঈদ মানে তো আনন্দ। কিন্তু আমাদের তো কোনো আনন্দ নেই।’
গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ানবাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজীব। বাসটি হোটেল সোনারগাঁওয়ের বিপরীতে পান্থকুঞ্জ পার্কের সামনে পৌঁছলে হঠাৎ পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে গা ঘেঁষে অতিক্রম করতে থাকে। এতে রাজীবের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর পর বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসা চলাকালে অভিমানী রাজীব বলেছিলেন ‘রাজীব কে? রাজীব তো মারা গেছে।’
আরও : আমার ঈদ কাটছে চিন্তা ও উত্তেজনায় : বুবলী
অবশেষে ১৬ এপ্রিল সত্যিই রাজীব চলে যান না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুর পর সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল একটি রিট করেন। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী আদেশ হিসেবে রাজীবের দুই ভাইকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের মালিককে নির্দেশ দেন। কিন্তু পরে বাস মালিক কর্তৃপক্ষের আবেদনে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের আদেশ দেন। ওই কমিটিই এখন রাজীবের দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী এবং ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নির্ধারণ করে ৩০ জুনের মধ্যে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দেবে। এর পর ৪ জুলাই ক্ষতিপূরণের বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দেবেন হাইকোর্ট।
এ ব্যাপারে ব্যারিস্টার কাজল জানান, আপাতদৃষ্টিতে বিলম্ব মনে হলেও রাজীবের দুই ভাই ক্ষতিপূরণ পাবেই।
তারা যাতে অর্থ পায়, আপিল বিভাগও সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলেছেন। সে কারণে আমি মনে করি জুলাইয়ের মধ্যেই হাইকোর্ট থেকে তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। এদিকে রাজীবের মারা যাওয়ার পর অসহায় দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল। কিন্তু রাজীবের ভাই মেহেদি হাসান বলে, ‘আমাদের দুভাইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত তিনি তা নেননি। আমাদের দায়িত্ব না নিলে বলে দিলেই পারেন।’
জানা যায়, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালে ২০০৫ সালে রাজীবের মা মারা যান। ছোট দুই ভাই মেহেদী ও আবদুল্লাহর বয়স তখন দুই বছর ও ছয় মাস। থাকতেন নানাবাড়িতেই। শুরুতে তাদের লালন-পালন করতেন নানি পিয়ারা বেগম ও নানা মোকলেচুর রহমান। চার মাস পর নানিও মারা যান। দুই বছর পর মারা যান নানা। স্ত্রীর মৃত্যুর পরই অপ্রকৃতিস্থ রাজীবের বাবা হেলাল উদ্দিন নিরুদ্দেশ হন। তবে ২০১১ সালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় তিনিও মারা যান। অসহায় এই তিন ভাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন খালা জাহানারা বেগম।
খালার বাড়িতে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রাজীব রাজধানীতে আসেন। উঠেন যাত্রাবাড়ীর একটি মেসে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্র্যাফিক্স ডিজাইনের কাজ শেখেন। ছাত্র পড়াতেন বেশ কয়েকটি। দম ফেলার ফুরসত ছিল না। লক্ষ্য ছিল একটিই নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর ভাই দুটিকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা। তবে সবাইকে কাঁদিয়ে অকালেই চলে যান রাজীব। বুধবার খালা জাহানারা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘গত বছর রাজীবসহ সবাই আমার বাসায় ঈদ করে। এবার সে নেই। রাজীবের তিনটি চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে। আমি পিয়নকে বলেছিÑ আর কোনো কার্ড না দিতে।’ উৎস: দৈনিক আমাদের সময়।