বুধবার, ২৩শে মে, ২০১৮ ইং ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

সুস্বাস্থ্য ও আরোগ্য লাভের মাস রমজান

ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মাসে রোজা রেখে, ইবাদত বন্দেগি করে, তারাবির নামাজ পড়ে পরম করুপাময় আল্লাহতায়ালার কাছে নাজাত, মাগফিরাত ও রহমত কামনা করেন।

এ মাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিশেষ রজনী হচ্ছে পবিত্র লাইলাতুল কদর, যে রাতে পবিত্র কোরআন শরিফ নাজিল হয়েছে। সুতরাং এ মাসের পরিপূর্ণ সিয়াম সাধানার জন্য সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। রোজা পালনের জন্য এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য যা করা প্রয়োজন-

* রোজার সময় ১০-১৪ ঘণ্টা উপবাস থাকতে হয় এ জন্য ইফতার, ইফতার পরবর্তী আহার এবং সেহরির খাবার সুষম এবং উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী বাঞ্ছিত হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে ইগও নির্ধারণ করে কোনো ডায়েটেশিয়ানের পরার্মশ মতো খাবারের ছক তৈরি করতে হবে।

* যেসব খাবার সহজে হজম হয় সেগুলো গ্রহণ করা ভালো।

* বেশি ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

* ফাস্টফুড, জাংকফুড, চিপস, পিজ্জা, রঙিন পানীয় পরিহার করা ভালো।

* প্রচুর পরিমাণে পানীয়, তাজা ফলের রস এবং লেবুর শরবত গ্রহণ করা প্রয়োজন।

* লাল মাছ মাংস, চর্বিযুক্ত মাছ মাংস গ্রহণ না করা ভালো।

* মদ্যপান, ধূমপান, তামাক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ পরিত্যাজ্য।

* যাদের গা খুব বেশি ঘামে তাদের ওরাল স্যালাইন বা ডাবের পানি খাওয়া বাঞ্ছনীয়।

রোজার সময় যেসব রোগবালাই হতে পারে

* রোজার প্রাক্কালের সবচেয়ে প্রথম যে সমস্যা তৈরি হয় তা হল ঘুম না হওয়া, বা কম হওয়া বা অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়া। সাধারণত সেহরি খাওয়ার কারণে প্রথমদিকে স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। এটা সাময়িক একটা সমস্যা এবং পর পর কয়েকদিন রোজা রাখলে এটা শরীরে ধাতস্থ হয়ে যাবে। তবে যদি কারও এটা সর্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত থাকে তবে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ঘুমের ওষুধ যেমন ডায়াজেপাম, রিলাক্সেন খাওয়া যেতে পারে।

* ইফতারির সময় বেশি ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত খাবার, রঙিন খাবার গ্রহণের ফলে বুক জ্বালপোড়া করা, অম্ল ঢেঁকুর ওঠা বা এসিডিটি পেটে ব্যথা হতে পারে। যাদের আগে থেকে পেপটিক আলসার ডিজিজ আছে তাদের এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো অম্লনাশক ওষুধ বা এন্টাসিডজাতীয় ওষুধ ইফতার, ইফতার পরবর্তী খাবার বা সেহরির মাঝখানে গ্রহণ করা যেতে পারে। ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া ভালো।

* রোজার প্রথমদিকে আরেকটি প্রধান অসুবিধা হল কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনসস্টিপেশন। এটা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় যাদের তামাক, সিগারেটজাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস আছে এবং যারা পানি ও ফলের রস কম গ্রহণ করে থাকে। এসব ব্যক্তিরা প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, তাজা ফলমূল খেলে এবং প্রচুর পানি এবং ফলের রস গ্রহণ করলে এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির বেলায় চিকিৎসকের পরামর্শমতো ল্যাক্সটিভ ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে।

* কোনো কোনো রোজাদারদের বেলায় বদহজম পাতলা পায়খানা ও আমাশয় হতে পারে। এগুলো সাধারণত অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পানি, ফলের রস এবং খাবারের কারণে হয়ে থাকে। এসব খাবার ও পানীয় আক্রান্ত ব্যক্তির হাত থেকে খাবারে সংক্রমিত হয়। এজন্য ইফতারি ও অন্যান্য খাবার ও পানীয় কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং এর পরই এগুলো ক্রয় করে গ্রহণ করতে হবে। বেশি পরিমাণে ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি বা বদহজম হলে ডাক্তারের পরামর্শমতো ওরাল স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটক এবং অ্যান্টিডিসেন্ট্রিক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।

* রোজাদারের কোনো কোনো সময় তীব্র গরম এবং ঘামের কারণে অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পরে। এর সঙ্গে হিট স্ট্রোক হয়ে রোগী মূর্ছা যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গায়ে চুলকানি, র‌্যাশ ইত্যাদিও হতে পারে। কোনো কোনো রোজাদারের ক্ষেত্রে মাংসপেশির ক্র্যাম্পও হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে ঠাণ্ডা কোনো জায়গায় শুয়ে বিশ্রাম করতে হবে, প্রচুর পরিমাণ ওরাল স্যালাইন খেতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনট্রাভেনাস স্যালাইন নিতে হতে পারে।

ডায়েবেটিসের রোগীরা কী রোজা রাখতে পারবে

ডায়াবেটিস একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। সীমিত খাবার গ্রহণ, মুখে খাবার ডায়াবেটিস বড়ি এবং ইনসুলিন সময়মতো গ্রহণ করা এবং শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম বেশি করা, মিষ্টি, শর্করা এবং চর্বিজাতীয় খাদ্য কম গ্রহণ বা পরিহার করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কাজেই বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখার ব্যাপারে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ইনসুলিন এবং খাবার বড়ির ডোজ বা মাত্রা এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো সময় নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে ইফতারির সময়, সেহরির সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ নির্ণয় করে ওষুধ অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে। যেসব ডায়াবেটিক রোগীর জটিলতা বা কপ্লিকেশন আছে যেমন হার্টের অসুখ, কিডনি ফেইলুর আছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শমতো এবং রোগের ধরন ও গভীরতা থেকে নির্ধারণ করতে হবে যে সে রোজা রাখতে পারবে কিনা।

ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, যে কোনো সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা ও পুরুষ এবং পেপটিক আলসার ডিজিজ, ডায়াবেটিক রোগীর রোজা রাখার কোনো বাধা নিষেধ নেই। শুধু সঠিক এবং সুষম খাবার গ্রহণ, প্রচুর পানীয় এবং তাজা ফলের রস গ্রহণ, ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া, ফাস্টফুট, জাংকফুড কম খাওয়া, তামাক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার সর্বোপরি চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ গ্রহণ করে যে কেউই রোজা রাখতে সক্ষম। খুব বেশি অসুস্থ, গর্ভবতী মা ও দুগ্ধ প্রদানকারী মা, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, মানসিক রোগী এদের রোজা না রাখাই ভালো। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সুস্থ অবস্থায় রোজা রাখার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, প্যাথলজি বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ

Print Friendly, PDF & Email