জ্বলছে শ্রীলঙ্কা : নেপথ্যে মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধগোষ্ঠী?
শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলের আমবাতেন্না শহর। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে পাহাড় ঘেরা এ শহরে। বুধবার শহরের বুকে মুসলিমদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালিয়েছে সিংহলি বৌদ্ধরা। শত শত বৌদ্ধ লাঠি-সোটা, পাথর ও পেট্রল বোমা হাতে আমবাতেন্নার আনাচে-কানাচে মুসলিমদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শহরের ওয়েলেকাদা এলাকায় মুসলিমদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করেছে উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা। সিংহলি বৌদ্ধদের এ তাণ্ডব অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দেখেছে প্রায় দুই ডজন পুলিশ ও সেনাসদস্য।
ফাতিমা জামির নামে এক মুসলিম বলেন, ‘আমরা প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম।’ তিন সপ্তাহ বয়সী তার শিশুকে আঁকড়ে ধরে সহিংসতা ঘটনা ভাবছেন আর আঁতকে উঠছেন তিনি। বুধবার সকালে তার বাড়ি-ঘরে রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছে বৌদ্ধরা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তারা আমার ঘরের সব জানালা ভাঙচুর করেছে। আমাদের পুরো ঘর পুড়ে গেছে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রায় ২০০ থেকে ৫০০ বৌদ্ধ ওয়েলেকাদায় কারফিউ ও জরুরি অবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হামলা করেছে। ক্যান্ডিতে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার জেরে মঙ্গলবার দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট মাইথিরিপালা সিরিসেনা।
ওয়েলেকাদায় দাঙ্গাবাজরা শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলিমদের অন্তত ১৫টি বাড়ি, একটি মসজিদ ভাঙচুর করেছে। এছাড়া চারটি ভবন ও বেশ কিছু গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
মুসলিমদের ওপর হামলার এসব ঘটনায় শ্রীলঙ্কায় অতীত অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত ফিরে আসার শঙ্কা বাড়ছে। মাত্র কয়েক বছর আগে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ার এ দ্বীপ দেশটিতে।
শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় গত রোববার। ওইদিন ক্যান্ডির তেলেদেনিয়ায় একটি সড়ক দুর্ঘটনার জেরে বৌদ্ধ এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে একদল মুসলিম। বৌদ্ধ ধর্মীয় বিভিন্ন স্থাপনা ও চা চাষের জন্য বিখ্যাত এ ক্যান্ডি।
পরের দিন শত শত সিংহলি বৌদ্ধ; যাদের অধিকাংশই বহিরাগত, ক্যান্ডিতে তাণ্ডব চালায়। জ্বালিয়ে দেয় মুসলিমদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর ও মসজিদ। পুড়ে যাওয়া একটি ভবনের ভেতর থেকে ২৩ বছর বয়সী এক মুসলিম যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সহিংসতা আরো ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় দেশটির সরকার মঙ্গলবার জরুরি অবস্থা জারি করে। সেনাবাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি ক্যান্ডিতে পুলিশি কারফিউ জারি করা হয়। তবে সহিংসতা থেমে নেই। এখনো চলছে। পুলিশের মুখপাত্র রুয়ান গুনাসেকারা বলেছেন, ‘বুধবার রাতভর চারটি শহরে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি বলেন, মেনিখিন্নায় সংঘর্ষে তিন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। দিনের শেষভাগে আমবাতেন্নায় হামলা হয়। সিংহলি এক তরুণ হাতে তৈরি গ্রেনেড বহন করার সময় বিস্ফোরণে মারা গেছে।
দাঙ্গা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা। ওই এলাকায় সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া দেশজুড়ে তিনদিনের জন্য ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে।
২৭ বছর বয়সী সুকরি কাশিমের চারটি শোয়ার ঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। ওয়েলেকাদার বাড়ির গ্যারেজে পুড়ে যাওয়া গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন তিনি।
‘আমরা নিরাপদ বোধ করছি না। আমাদের সব শিশুই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আমরা জানি না কোথায় যাবো অথবা কার ওপর আস্থা রাখবো।’
‘আমরা জানি না কেন এ ঘটনা ঘটছে। উত্তেজিত জনতা আমাদের এলাকার নয়। আমরা তাদের চিনি না। কিন্তু তারা তো আমাদের এলাকার লোকজনের সমর্থন ছাড়া এসব করতে পারবে না। কারণ তারা অমুসলিমদের বাড়ি-ঘর বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মুসলিমদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালাচ্ছে।’
অল্প কিছুসংখ্যক মানুষ এ সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন কাশিম। তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই ক্যান্ডির বৌদ্ধ এবং মুসলিমদের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ।
‘আমরা ধর্মীয় উৎসবের সময় পরস্পরে খাবার ভাগাভাগি করি। আমরা একসঙ্গে খেলাধুলা করি। একে অন্যের দোকান থেকে পণ্য-সামগ্রী কেনাকাটা করি।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশটির তিন দশকের যুদ্ধের অবসানের পর থেকে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৌদ্ধদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সন্ন্যাসী বোদু বালা সেনা। বৌদ্ধ এ সন্ন্যাসীর সঙ্গে মিয়ানমারের কট্টরপন্থী উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষক আলান কিনান বলেন, শ্রীলঙ্কা এখন খাঁদের কিনাড়ে। এ হামলা সুসংগঠিত এবং সু-পরিকল্পিত। এবং এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ঠ ভালো কারণ আছে যে, তারা মুসলিমদের সহিংসতায় পরিকল্পিতভাবে উসকে দিচ্ছে; যাতে পরবর্তীতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরো বেশি সহিংসতা চালানো যায়।
সূত্র : আলজাজিরা, এপি, তামিল গার্ডিয়ান।