ছোট্ট শিমু, আমরা আমাদের কথা রেখেছি!
বেলা প্রায় ৩টা। দুপুরের খাবার খাচ্ছি। একটা ফোন আসলো। রিসিভ করলাম, ফোনের অপর প্রান্তে অফিসার ইনচার্জ, মনোহরগঞ্জ। জানালেন, মনোহরগঞ্জের উত্তর হাওলা ইউনিয়নের হাতিমারা গ্রামে ০৮ বছরের এক শিশু নৃশংসভাবে খুন হয়েছে। তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আধঘণ্টার মধ্যে ঘটনা স্থলের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখি জনস্রোত; গন্তব্য বিলের মাঝখানে একটি বাড়ি। বাড়িটি কৃষক সায়েদুল হকের। চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত; প্রশান্তির সবুজ। অথচ এই বাড়িতে আজ অশান্তি আর শোকের ছায়া! আলক্ষেত পেড়িয়ে বাড়িতে যাই সাথে মনোহরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ, ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এবং নাথেরপেটুয়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জসহ ফোর্স। বাড়িতে শত শত মানুষের ভিড়। তাদেরকে বুঝিয়ে ঘটনাস্থল কর্ডন করা হলো। ০৮ বছরের শিশু শিমু আক্তারের নিথর দেহ পড়ে আছে বাড়ির আঙিনায়।
ওর বাবা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। কথা বললাম। সহজ সরল মানুষ। অন্যের জমিতে কাজ করেন। আজকেও যথারীতি আরেকজনের জমিতে সার দিতে গিয়েছিলেন শিমুকে বাড়িতে একা রেখে। শিমুর বড় বোন মাদ্রাসায় গিয়েছে। আর ওদের মা শিমুর ছোট বোন আর ভাইকে নিয়ে সিলেটে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। শিমু বাড়িতে একা থাকা অবস্থায় অপরাধী/অপরাধীরা শিমুকে ধর্ষণ পূর্বক হত্যা করে; নৃশংসভাবে হত্যা! শিমুর বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তার সাথে কারো জায়গা সম্পত্তি/আর্থিক বা অন্য কারণে কোন দ্বন্দ্ব নেই!
০৮ বছরের শিশু, প্রেম/প্রত্যাখ্যান কিংবা পরকীয়া সংক্রান্ত কিছু হবার সুযোগ নেই! তবে বটি দিয়ে ভয়াবহভাবে কুপিয়ে মুখমণ্ডল বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। মনে হলো কেউ ক্ষোভের বশীভূত হয়ে এই নির্মম কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। পূর্ব পরিচিত কেউ হবে হয়তো। ঘটনা স্থলের চারপাশটা ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলাম। দুই রুমের দো-চালা টিনের ঘরের যেখাটায় শিমুর লাশ পাওয়া যায়, সেই জায়গাটা এখনো রক্তে ভেসে যাচ্ছে; সারা বাড়িতে রক্তের গন্ধ! দুটি রক্ত মাখা বটি দা পড়ে আছে! আঁচ করতে পারলাম, আসামি এটলিস্ট দুই! নিহত শিমুর বাবা/বোনের সাথে কথা বলে বুঝলাম ওরা কাউকে সন্দেহ করছে না। সায়েদুল হক বললো, স্যার, আমি নিরীহ মানুষ; আমার কোন শত্রু নেই । মনে মনে বললাম, পাষন্ড অপরাধীরা কি আর এসব বুঝে!!
বিলের মাঝখানে খালি বাড়ি। বাড়িতে শিশুকে একা পেয়ে পরিচিত কোন পাষণ্ড এই কাজ করতে পারে এই ভাবনায় জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের বাড়িতে আপনার আত্নীয় স্বজন সহ নিয়মিত আসা যাওয়া করেন কারা? তিনি বললেন, তেমন কেউ আসে না।
একটু দূরে গিয়ে, স্থানীয় একজনের সাথে কথা বললাম। জানতে চাইলাম এখানে আশেপাশে ধান ক্ষেতে পানি দিতে এসে এই বাড়িতে বিশ্রাম নিতে কেউ আসতো কি না? কিংবা এখানে কারা বেশি বেশি আসতো। একজন বললো, হামজা নামের একজন গতকাল আসছিলো দেখেছি । হামজা সম্পর্কে নিহত শিমুর দূর সম্পর্কীয় মামা। তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে শ্যালো মেশিন চালায়। হামজাকে ঘটনাস্থলেই পেলাম। তাকে ডাকলাম, কথা বললাম। কথাবার্তায় স্বাভাবিক মনে হলো। বললো, স্যার আমার বোনের বাড়ি। আমি পাশেই মেশিন চালাই । এখানে আসি । একটু সন্দেহ হলো। কিন্তু, বুঝতে দিলাম না। তখন,আমরা ওর বাবাকে আবারো জিজ্ঞেস্ করলাম আপনার বাড়িতে ইদানিং আজ- কাল কারা কারা এসেছে একটু মনে করে বলুন। তখন, পাশে দাঁড়ানো তার বড় মেয়ে বললো এক চটপটি ওয়ালা গতকাল এসে ঘুরঘুর করেছে ।
একথা শোনার পর, স্থানীয় বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে খবর নিলাম। নাম বাচ্চু মিয়া, এই গ্রামেই বাড়ি। জানলাম, লোক সুবিধার না। দুজন, অফিসার পাঠিয়ে খবর নিলাম সেই চটপটিওয়ালা এখন কোথায় আছে। জানতে পারলাম, প্রতিদিন এই সময়ে (বিকেল ৫টা) সে স্টেশনে চটপটি বিক্রি করতে আসলেও আজ এখনো আসেনি। সন্দেহ বাড়লো ! তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্থানীয় তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বলে আমরাও ম্যুভ করলাম! তদন্ত কেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম মাঝবয়সী এক ব্যাক্তি, এক হারা গড়নের। চেহারায় বিরক্তি, ভয় আর অতি লোক দেখানো কনফিডেন্স পড়া যাচ্ছে। তাকে বলতে দিলাম সে গত তিনদিন কোথায়, কখন, কি করেছে, কার সাথে ছিলো। বলে গেলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম টাইম ওয়াইজ! এবার প্যাচ লাগিয়ে ফেললো! গড়মিল লক্ষ্য করলাম! সে যে গতকাল এ বাড়িতে এসেছিলো এই বিষয়টিও এড়িয়ে যায়! একটু থতমত খেলেও তার গলার জোর কমেনি! এমনটা হয়, আগেও দেখেছি!
সে কখন কি করেছে, সাথে কে ছিলো তা ভেরিফাই করার জন্য তার বাড়িতে, পরিবার/সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলার জন্য দুজন অফিসার পাঠালাম। ঘরের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য বললাম। আমি আর ওসি, মনোহরগঞ্জ ওর কাপড় চোপড় মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম। দুজনের মুখেই একটু হাসি ফুটে ঊঠলো।
আমরা কেনো হাসছি, এটা বোধকরি অভিযুক্ত বাচ্চু বুঝে ফেলেছে। আমরা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে উঠলো, না স্যার এটা লোহার দাগ। বুঝলাম, এই জিনিসের আই কিউ ধারণার অনেক উর্ধ্বে।
আসলে ওর শার্টের নিচের অংশ খানিকটা ভেজা আর রক্তের মতো লালচে দাগ ছিলো! যাই হোক,ওকে একটু সহজ হবার সুযোগ দিয়ে এটা ওটা জানছি। এমন সময় দুই অফিসার ফিরে এসে জানালো, স্যার ওর কথার সাথে সংশ্লিষ্টদের কথার ৯০% মিল আছে। মনে মনে বললাম, এই ১০% ই তো শুভঙ্করের ফাকি। এই ঘটনা ঘটতে ৩০ মিনিট যথেষ্ট! প্যাচ তো একটা আছে।
ওর হাত, পা, ঘাড়, গলা এবং শার্টের অন্যান্য জায়গা আবারো দেখলাম। দেখলাম হাতের আঙুল একটু কাটা। ফ্রেশ কাটা, দুই তিন ঘণ্টা বয়সি কাটা! বলার আগেই বাচ্চু বলে ফেললো স্যার, রডে লেগে কেটে গেছে।
বুঝলাম,,,,, । চোখে ভেসে ঊঠল একটি সহজ সরল বাবার নিস্পাপ শিশুকে কুপিয়ে হত্যা করছে মানুষরূপী পশু!
তারপর, বাকিটা সময়ের ব্যাপার মাত্র! একটু সময় নিয়েছে আর কি! সে অপরাধ স্বীকার করল। ঘটনায় জড়িত আরো একজন। হ্যা, সেই হামজা। এতক্ষণ সে আমাদের নজরদারির মধ্যে ছিলো। এখন গ্রেপ্তারের পালা। গ্রেপ্তারকৃত হামজা বেশি সময় নেয়নি। পুরো ঘটনা বর্ণণা করলো। তাদের দুইজনের টার্গেট ছিলো নিহত শিমুর মাদ্রাসায় পড়া বড় বোন। খালি বাড়িতে তাকে না পেয়ে পাশবিক অত্যাচার চালায় ছোট্ট শিমুর ওপর। অপরাধীদের চিনে ফেলায় ওকে নির্মম ভাবে কুপিয়ে হত্যা করে! দুই মাঝবয়সী জন্তু কুপিয়ে অবুঝ শিশুটির মুখমণ্ডল বিকৃত করে ফেলে। এমন পাশবিকতা আর হিংস্রতার ব্যাখ্যা কি? লালসা (?) নাকি সাইকোসিস! এই ০৮ বছরের শিশু; ছোট্ট শিমুর চাঞ্চল্যকর হত্যার বিচার নিশ্চিতকল্পে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দেয়ার চেষ্টা করেছি। মনোহরগঞ্জবাসীকে কথা দিয়েছিলাম খুব দ্রুত আমরা এর রহস্য উদঘাটন করবো। কুমিল্লা জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন স্যারদের মূল্যবান দিকনির্দেশনা ও টিম মনোহরগঞ্জের টিম ওয়ার্কের ফলে ঘটনার মাত্র ৩৬ ঘন্টার মধ্যে রহস্য উদঘাটিত, আলামত উদ্ধার ও আসামি গ্রেপ্তারসহ স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি নিশ্চিত হয়েছে।
ধন্যবাদ টিম কুমিল্লার অভিভাবক সম্মানিত পুলিশ সুপার স্যার সহ অন্যান্য স্যারদের। ধন্যবাদ অফিসার ইনচার্জ, মনোহরগঞ্জ ও আইসি নাথেরপেটুয়াকে!
লেখক : সিনিয়র এএসপি, লাকসাম সার্কেল, কুমিল্লা